আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হলেও এখনো কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। গতকাল শনিবার ছিল প্রচারণার দ্বিতীয় দিন। মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী চার প্রার্থীই দিনভর প্রচারণা চালিয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি হয়নি; ভোটের মাঠে নেই তেমন আলোচনা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সাধারণত কাউন্সিলর প্রার্থীরাই কেন্দ্রে ভোটার আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন। এবার কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনে কাউন্সিলরদের ভোট না হওয়ায় নির্বাচনে কিছুটা নিষ্প্রাণ ভাব। এ অবস্থায় নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা নিয়েই চিন্তায় রয়েছেন প্রার্থীরা।
কুমিল্লার ইপিজেড এলাকার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে মূলত কাউন্সিলর প্রার্থীরাই ভোটার আনার উদ্যোগ নেয়। আমার ধারণা, কাউন্সিলর ভোট না থাকায় এ নির্বাচনে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি ভোটার কেন্দ্রে যাবে না।’
অবশ্য এর ভিন্নমত জানান ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সরকার মাহমুদ জাবেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কাউন্সিলর ভোট না থাকলেও সব কাউন্সিলর মাঠে কাজ করছেন। সবাই কেন্দ্রে ভোটার নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
তবে কুমিল্লার রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন, এমন ব্যক্তিরা বলছেন, নানা কারণে এবার ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি ভোটার বাড়ার উপলক্ষও রয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে এবং কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বেশি হলে ফলাফলের ক্ষেত্রে একটা চমকের সম্ভাবনা থাকবে। এখন পর্যন্ত পরিবেশ শান্ত আছে। যদিও ইতিমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী চার মেয়র পদপ্রার্থীর তিনজনই অভিযোগ করেছেন, ভোটার উপস্থিতি কমানোর জন্য এখন থেকেই পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে মূলত কাউন্সিলর প্রার্থীরাই ভোটার আনার উদ্যোগ নেয়। আমার ধারণা, কাউন্সিলর ভোট না থাকায় এ নির্বাচনে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি ভোটার কেন্দ্রে যাবে না।কুমিল্লার ইপিজেড এলাকার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী মাহবুবুর রহমান
এবার মেয়র নির্বাচনে চারজন প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে তাহসীন বাহার ‘বাস’ প্রতীক, মনিরুল হক ‘টেবিল ঘড়ি’ প্রতীক, মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন ‘ঘোড়া’ প্রতীক ও নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম ‘হাতি’ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাহসীন বাহার স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। আর মাহমুদ তানিম মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। মনিরুল হক দুবারের সাবেক মেয়র। আর নিজামউদ্দিন গত নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৯ হাজার ৯৯ ভোট পান।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকটি কারণে সিটির মেয়র নির্বাচন নিয়ে অনেক ভোটারের মধ্যে সেভাবে উৎসাহ নেই। কারণ, গত ২০ মাসের মধ্যে কুমিল্লা সিটি এলাকার ভোটারদের জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তিনবার ভোট দিতে হচ্ছে। ফলে একের পর এক ভোটে কিছুটা ক্লান্তিওÍভর করেছে ভোটারদের মধ্যে।
এবার মেয়র নির্বাচনে চারজন প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে তাহসীন বাহার ‘বাস’ প্রতীক, মনিরুল হক ‘টেবিল ঘড়ি’ প্রতীক, মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন ‘ঘোড়া’ প্রতীক ও নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম ‘হাতি’ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, নির্বাচন নিয়েই ভোটারদের মধ্যে ‘অনীহা’ এবং ‘আস্থার সংকট’ রয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের কুমিল্লা জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরপর তিনটি নির্বাচনকে আমি বিচ্ছিন্ন মনে করি না। তবে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটারদের যেমন অনীহা ছিল, এখানেও সেটার প্রভাব পড়বে। এ নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। নির্বাচনগুলোতে যদি ভোটারদের গুরুত্ব থাকত, তাহলে নির্বাচন প্রাসঙ্গিকভাবে অর্থবহ হতো। এবারের সিটি নির্বাচনেও ভোটারদের অনীহা থাকবে বলে মনে করি।’
সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আরফানুল হক (রিফাত) মেয়র হন। এরপর দেড় বছরের মাথায় গত ৭ জানুয়ারি অনিুষ্ঠত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মেয়র আরফানুল হকের মৃত্যুতে জাতীয় নির্বাচনের দুই মাসের মাথায় আগামী ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন। ফলে ২০ মাসের মধ্যে তিনবার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ এবং উৎসাহের অভাব—দুটোই রয়েছে।
এ ছাড়া গত জাতীয় সংসদ ও সিটি নির্বাচন—দুটোই বর্জন করে বিএনপি। এর মধ্যে বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসনে ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এবারের মেয়র নির্বাচনেও বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিচ্ছে না। তবে দল থেকে বহিষ্কৃত দুই নেতা মনিরুল হক ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন মেয়র নির্বাচনে গতবারও ছিলেন, এবারও তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন।
পরপর তিনটি নির্বাচনকে আমি বিচ্ছিন্ন মনে করি না। তবে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটারদের যেমন অনীহা ছিল, এখানেও সেটার প্রভাব পড়বে। এ নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। নির্বাচনগুলোতে যদি ভোটারদের গুরুত্ব থাকত, তাহলে নির্বাচন প্রাসঙ্গিকভাবে অর্থবহ হতো। এবারের সিটি নির্বাচনেও ভোটারদের অনীহা থাকবে বলে মনে করি।সুজনের কুমিল্লা জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম
যদিও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে গত সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় দুজনকেই দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। তবু বিএনপির দুজনের প্রার্থিতার কারণে সেই নির্বাচন কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। ভোট পড়ে ৫৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
অবশ্য এবার নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী তাহসীন বাহার গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে ভোটের যে উৎসবমুখর পরিবেশ হবে, তার ওপর ভোটার উপস্থিতি নির্ভর করবে। অনেক কাউন্সিলর দলের (আওয়ামী লীগ) জন্য নিবেদিত, তাঁরা কাজ করবেন।’
গত সিটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের চেয়ে কুমিল্লা সিটিতে বিএনপি সমর্থক ভোটার বেশি। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরফানুল হক ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেও বিএনপির বহিষ্কৃত দুই নেতা ৭৯ হাজার ৬৬ ভোট পান, যা বিজয়ী আরফানুলের চেয়ে ২৮ হাজার ৭৫৬ ভোট বেশি। অবাধ ও সুষ্ঠুœ পরিবেশে ভোট হলে এবারও সে রকম কিছু হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
যদিও ভোট পর্যন্ত পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকে কি না, তা নিয়ে খোদ প্রার্থীদের মধ্যেই শঙ্কা আছে। ইতিমধ্যে মেয়র প্রার্থী মাহমুদ তানিম অভিযোগ করেছেন, কুমিল্লা ভয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। আর নিজামউদ্দিন বলেছেন, পুরো বাংলাদেশই তো এখন ভয়ের দেশ। কুমিল্লা হয়তো একটু বেশি।
আসলে ভোটের যে উৎসবমুখর পরিবেশ হবে, তার ওপর ভোটার উপস্থিতি নির্ভর করবে। অনেক কাউন্সিলর দলের (আওয়ামী লীগ) জন্য নিবেদিত, তাঁরা কাজ করবেন।মেয়র পদপ্রার্থী তাহসীন বাহার
নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশ এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের এই শহরে অশান্তি কোত্থেকে সৃষ্টি হয়, সবাই জানে। এমপি সাহেব (বাহাউদ্দিন) মেয়েকে (তাহসীন বাহার) নিয়ে যত্রতত্র মিটিং করছেন, বর্ধিত সভার নামে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন দেখেও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।’
তাহসীন বাহার এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘এমপি সাহেব তো দলের (মহানগর আওয়ামী লীগ) সভাপতি। উনি কি দলের বর্ধিত সভায় যেতে পারবেন না। উনি তো সরাসরি নির্বাচনী প্রচারণা করতে পারবেন না। কিন্তু উনি কি দলীয় সভাও করতে পারবেন না?’
এই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে আগামী ৯ মার্চ মেয়র পদের উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ইভিএমে।