সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের ঘোষণা, তাদেরও দফা একটি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিএনপির এক দফা দাবির বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, তাদেরও এক দফা, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।
গতকাল বুধবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে এই ঘোষণা দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘বিএনপির এক দফা হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আমাদেরও এক দফা, শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই হবে, শেখ হাসিনাই নেতৃত্ব দেবেন।’
আওয়ামী লীগের সমাবেশের দেড় কিলোমিটার দূরে নয়াপল্টনে আরেক সমাবেশ থেকে বিএনপি সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সন্ধ্যা ছয়টার পর যখন বক্তৃতা শুরু করেন, ততক্ষণে বিএনপির সমাবেশ শেষ। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির অনড় অবস্থানের বিপরীতে আওয়ামী লীগও সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার বিষয়ে অনড় থাকার ঘোষণা দেয়। এমনকি বিএনপির সঙ্গে আলোচনা কিংবা সংলাপের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
বিএনপির মতো আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা না দিলেও দলের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে টানা কর্মসূচি আসতে পারে বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘খেলা হবে, নির্বাচন পর্যন্ত। মাঠ ছাড়বেন না। যখনই ডাক দেব শেখ হাসিনার নির্দেশে, তখনই আপনারা মাঠে চলে আসবেন। কোনো অপশক্তির সঙ্গে আপস করব না।’
গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির প্রায় প্রতিটি কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থেকেছে। বিএনপির পরবর্তী পদযাত্রা কর্মসূচির পাল্টাও থাকবে বলে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চেয়ে গতকাল বিএনপি এবং এর জোটসঙ্গী ও সমমনা দলগুলো পৃথকভাবে এক দফা দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করে। বিএনপির এই কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ। দলটি এই সমাবেশের নাম দেয় ‘শান্তি সমাবেশ’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ওবায়দুল কাদের।
বেলা আড়াইটায় সমাবেশ শুরু হয়। এর আগে দুপুর ১২টা থেকেই নেতা-কর্মীরা জমায়েত হতে শুরু করেন। বিকেল নাগাদ জমায়েত বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে এক দিকে জিরো পয়েন্ট, অন্যদিকে গুলিস্তান মোড় ছাড়িয়ে যায়। অনেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকা, সচিবালয়ের আশপাশের সড়কেও অবস্থান নেন।
দায়িত্বশীল নেতা, দলের পদপ্রত্যাশী, জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধি হতে আগ্রহীদের নামে ব্যানার নিয়ে মিছিলসহ আসেন নেতা-কর্মীরা। এসব ব্যানার গুটাতে গলদঘর্ম হতে হয় কেন্দ্রীয় নেতা ও আয়োজকদের। কারণ, ব্যানারের কারণে সমাবেশে আসা ব্যক্তিরা পেছন থেকে দেখতে পারছিলেন না। সমাবেশ শুরুর আগে কিছুক্ষণ চেয়ার–ছোড়াছুড়ির ঘটনাও ঘটে। নেতারা পরে কর্মীদের নিবৃত্ত করেন।
সমাবেশের আয়োজক ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। তবে ঢাকা জেলা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ আশপাশের অনেক জেলা থেকেই বাস, পিকআপ, মিনিট্রাকে করে এসে নেতা-কর্মীরা সমাবেশে অংশ নেন। এর মধ্যে গাজীপুরের সাবেক মেয়র ও দল থেকে আজীবন বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলমের ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে অনেকে যোগ দিতে দেখা যায়।
দেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা তৎপরতা আছে। বর্তমানে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে মার্কিন একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। দুই সপ্তাহের সফরে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল। এর আগে নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে, যা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে ক্ষমতাসীনদের। এ নিয়ে ক্ষোভও আছে দলটির নেতাদের, যা গতকালের সমাবেশে কয়েকজন নেতার বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাম উল্লেখ করেননি। নেতাদের কেউ কেউ পশ্চিমা কূটনৈতিক তৎপরতাকে ‘ঘটক’ ও ‘মোড়ল’–এর ভূমিকা হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রায় সবাই এই তৎপরতাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।
ওবায়দুল কাদের তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘কোনো বাধা দেব না। কাউকে আক্রমণ করতে যাব না। ঢাকায় বিদেশি বন্ধুরা এসেছেন, তাঁরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করেন। আমাদেরও লক্ষ্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা দিতে আসবে, আমরা তাদের প্রতিহত করব।’
বিএনপি বিদেশিদের হাতে–পায়ে ধরে ক্ষমতায় বসার জন্য ভিক্ষা চাইছে—এমন অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বিদেশিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা আমাদের উন্নয়নের সহযোগী। আপনাদের আমরা সম্মান করি। কিন্তু বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত। রক্তে লেখা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যদি হস্তক্ষেপ করেন, তাহলে দেশের জনগণ মেনে নেবে না।’
বিদেশিরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ করেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কারও করদ রাজ্য নয়। অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চলবে না।
সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘ওই ঘটকেরা এখনো বাংলাদেশে আছে। একাত্তর সালে আমরা বহু বড় বড় দেশ মোকাবিলা করেছিলাম। সেই সময় আমাদের অনেক বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুরা এখনো আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের জয় অনিবার্য।’ তিনি বলেন, শেখ হাসিনার অধীনেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। যারা আজকে ওকালতি করছে, তখন তারাও শেখ হাসিনার পক্ষ নেবে।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী। সমাবেশ পরিচালনা করেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান। অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর কবির নানক; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ও মাহবুব উল আলম হানিফ; সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির প্রমুখ। এ ছাড়া মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম প্রমুখ।