বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার কোনো পথ খোলা রাখেনি বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি, বিএনপি সমঝোতা-আপসের কোনো পথ খোলা রাখেনি। বিএনপির দাবি সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে তো আমরা সমঝোতা করব না।’
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আজ সোমবার বৈঠক করেন ঢাকা সফরররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা। দুপুরে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠক হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল ইন্ডারফার্থ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির সাবেক উপপ্রধান বনি গ্লিকের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের প্রাক–নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফর করছেন।
বৈঠক শেষে মার্কিন প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের পক্ষ থেকে সেখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কিছু বলা হয়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈঠকে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা তুলে ধরেন। বাংলাদেশে নির্বাচনী পরিবেশ মূল্যায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদল এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা অন্যদের মতো আমাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। ১২ সদস্যবিশিষ্ট এই প্রতিনিধিদল। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমরা আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ নিয়েও কথা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে চায়, তা প্রতিনিধিদলকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সরকার গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে ৮২টি সংস্কার করেছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে জাতির কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে অঙ্গীকার, সে বিষয়েও প্রতিনিধিদলকে বলেছেন।
দেশের ৭০ ভাগ ভোটার শেখ হাসিনাকে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে বলে আইআরআইয়ের জরিপে উঠে এসেছে, সেই তথ্য বৈঠকে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তারা আমাদের মনোভাব জানতে চেয়েছে, আমরা কী করতে চাই, কেমন নির্বাচন চাই, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখছি।’
মার্কিন প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মধ্যস্থতা করতে আসেনি জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তারা এখানে একটা ভালো নির্বাচন দেখতে চায়। আমরাও বলেছি, অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। তাদের কথাবার্তা ইতিবাচক ছিল। কোনো পক্ষ নিয়ে কথা বলেনি।’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতবিরোধ সমাধান করা মার্কিন প্রতিনিধিদলের উদ্দেশ্য নয় বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘তারা পরিস্থিতি বুঝতে চায়। নির্বাচনের পরিবেশ, বাস্তব অবস্থা, সংঘাতের আশঙ্কা আছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণ করছে।’
এর আগে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টার ওই বৈঠক হয় ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে তাঁদের এক দফা দাবির সমর্থনে যুক্তি তুলে ধরেন বিএনপির নেতারা।
বৈঠকে আলোচনার মধ্যে বিএনপির দাবির বিষয়টি এসেছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তারা বলেছে, কম্প্রোমাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্ট (সমঝোতা ও আপসের) মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? আমরা বলেছি, কম্প্রোমাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য স্পেস থাকতে হয়। সেই স্পেস বিএনপি রাখেনি, ব্লক করে দিয়েছে।’
বিএনপির দাবির প্রসঙ্গে প্রতিনিধিদলকে কী জানিয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, প্রথমত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো মৃত একটি ইস্যুকে সামনে এনেছে। তাদের এক দফা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি, নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে হবে। এসব দাবির মুখে কীভাবে সমঝোতা হবে। বিএনপি বা বিরোধী দলের যেসব দাবি এখন চলছে, সে বিষয়ে প্রতিনিধিদল একটি কথাও বলেনি।
বিএনপির দাবি সংবিধানসম্মত নয় উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি সূচনা বক্তব্যেই বলেছি, গণতন্ত্র এমন একটি বিষয়, যেখানে কম্প্রোমাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্টের সুযোগ থেকেই যায়। কিন্তু বিএনপির দাবি তো সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে তো আমরা কম্প্রোমাইজ-অ্যাডজাস্টমেন্ট করব না। তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়। প্রতিনিধিদলকে জিজ্ঞাসা করেছি, কেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন? তিনি কি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন, নাকি জনগণের ঢল নেমেছে রাস্তায় যে প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় নিতে হবে।’
প্রতিনিধিদলকে বিএনপির ‘মিথ্যাচারের’ জবাব দিয়েছেন জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি যেসব অভিযোগ প্রতিনিধিদলের কাছে করেছে, তার জবাব দিয়েছে তারা। বিএনপি সভা-সমাবেশে ভুল তথ্য দেয়, মিথ্যাচার করে, আইনের ভুল ব্যাখ্যা দেয়, সে ব্যাপারে সঠিক বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কারও বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু দেশে এমন গুজব, মিথ্যাচার চলছে, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে জবাব দিতে হয়।’
প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে অংশ নেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফারুক খান, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না, তা যাচাই করতে এই প্রতিনিধিদল এসেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রাক্-নির্বাচন সমীক্ষা মিশন (পিইএএম) পরিচালনা করছে।
ঢাকায় আমেরিকান সেন্টারে গত ২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে ও মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার সাংবাদিকদের জানান, প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, রাজনৈতিক দল, নাগরিক পর্যবেক্ষক, নাগরিক সংগঠন এবং নারী ও তরুণদের সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবে। বাংলাদেশের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও প্রতিনিধিদলের সদস্যরা কথা বলবেন।
সফর শেষে প্রতিনিধিদলটি একটি বিবৃতি (পাবলিক স্টেটমেন্ট) দেবে। নির্বাচন আয়োজন বিষয়ে তাদের যদি কোনো উদ্বেগ থাকে, তা জানাবে এবং বাস্তবসম্মত সুপারিশ থাকলে তা-ও উল্লেখ করবে। প্রতিনিধিদলটি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অংশীদার ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা করবে। প্রতিনিধিদলটির প্রাথমিক লক্ষ্য হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তথ্য তুলে ধরা। এর পাশাপাশি তারা নির্বাচনের দিন সীমিতসংখ্যক আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানো হবে কি না, সে বিষয়ে মতামত দেবে।
এর আগে গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশসহ নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বাংলাদেশ সফর করে যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।