নারায়ণগঞ্জ থেকে কলকাতা হয়ে ‘খেলা হবে’ এখন ঢাকায়

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

ইউটিউব ঘেঁটে ছয় বছর আগের একটি ভিডিও পাওয়া গেল। নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভাষণ, ‘খেলা হবে’। ২ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে শামীম ওসমান তিনবার বলেছেন, ‘খেলা হবে’। ‘আমরা খেলব’ কথাটিও এসেছে কয়েকবার।

এই ‘খেলা হবে’ পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। এখন আবার কলকাতা হয়ে স্লোগানটি এল ঢাকায়।

গত বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার চলাকালে ‘খেলা হবে’ নিয়ে পাল্টাপাল্টির মধ্যে এভাবে ফুটবল নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েক দিন ধরেই ‘খেলা হবে’ বলছিলেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘খেলা হবে’। এরপর তিনি কিছুক্ষণ থামেন। এ সময় মাঠ থেকে নেতা, কর্মী ও সমর্থকেরাও সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘খেলা হবে’, ‘খেলা হবে’।

দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও ‘খেলা হবে’ স্লোগানকে নিয়ে আসছেন ওবায়দুল কাদের।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গত বছর ছিল বিধানসভা নির্বাচন। ওই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ‘খেলা হবে’ স্লোগানটি অনেকবার ব্যবহৃত হয়। ভারতের সাংবাদিক রঞ্জন বসু লিখেছেন, ‘ঠিক কীভাবে “খেলা হবে” সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিল, তা পরিষ্কার নয়। তবে যত দূর জানা যাচ্ছে, গত ডিসেম্বরে মেদিনীপুরের ডাকাবুকো নেতা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর নিজের খাসতালুক নন্দীগ্রামে প্রথম যে সভা করেছিলেন, সেখানেই তিনি “খেলা হবে” শব্দ দুটি প্রথম ব্যবহার করেন।’

তৃণমূল কংগ্রেস স্লোগানটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাল্টা স্লোগান দিতে বাধ্য হন। ‘খেলা হবে’র জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘এবার খেলা শেষ’। অবশ্য ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের খেলা শেষ করতে পারেনি; বরং বিপুল ভোটে তৃণমূলের কাছে ধরাশায়ী হয় বিজেপি।

‘খেলা হবে’ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গান হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে গান ভাইরাল হয়েছে। ১৬ আগস্টকে ‘খেলা হবে’ দিবসও পালন করে তৃণমূল কংগ্রেস।
তৃণমূলের দাবি, ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ফুটবল দল ইস্ট বেঙ্গল ও মোহনবাগানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১২ জন মারা যান। এদিনকে ‘খেলা হবে’ দিবস হিসেবে পালনের মাধ্যমে তৃণমূল বাঙালিদের ফুটবলের প্রতি আবেগ বোঝাতে চেয়েছে। অবশ্য বিজেপি দিনটিকে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু ‘খেলা হবে’ স্লোগানের যিনি মেধাস্বত্বের দাবিদার, সেই শামীম ওসমান বছরখানেক আগে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতে যে পরিপ্রেক্ষিতে স্লোগানটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা তাঁর দেওয়ার বক্তব্যের ‘স্পিরিটে’র (চেতনা) সঙ্গে মেলে না। কেন, সেই কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্লোগানটি দেওয়া হয়েছিল ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে। তখন এ কথা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিপক্ষে। এর ‘স্পিরিট’ অনেক বেশি ছিল।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, এত সহজে কোনো কিছু হবে না। রাজপথে আন্দোলনে ‘খেলা হবে’, নির্বাচনে ‘খেলা হবে’। ‘খেলা হবে’ আরও অনেক বিষয়ে।

ঢাকায় গতকাল ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আন্দোলনে খেলা হবে। নির্বাচনে খেলা হবে। ভোট চুরির বিরুদ্ধে খেলা হবে। ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে খেলা হবে। খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। যারা ১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাদের বিরুদ্ধে খেলা হবে। খেলা হবে প্রহসনের নির্বাচনের বিরুদ্ধে।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘ভোট চুরির বিরুদ্ধে’,‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’,‘প্রহসনের নির্বাচনে’র বিরুদ্ধে যে খেলার কথা বলেছেন, তা যদি সত্যি হয়, দেশে যদি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়, তাহলে তা দেশের জন্য ভালো খবর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার এই লেখককে বলছিলেন, শব্দের ব্যবহার নিয়ে ছুৎমার্গের কিছু নেই। ‘খেলা হবে’ শব্দদ্বয়ের ব্যবহারের মধ্যে কিন্তু আপত্তির কিছু তিনি দেখেন না। তিনি মনে করেন, প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা অর্থে যদি ‘খেলা হবে’ কথাটির ব্যবহার হয়, সেটা ভালো। তবে প্রতিশোধ বা দেখে নেওয়ার অর্থে ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।  

বিএনপি ‘খেলা হবে’র জবাব আগেই দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে যুবদলের এক সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। তারপরই রাজপথে আওয়ামী লীগের সঙ্গে খেলা হবে, এর আগে নয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগে সরকারের পদত্যাগ চান, তারপর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে খেলতে চান তিনি

দুই দলের এই ‘খেলা’য় বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাবে, তা বলা মুশকিল। তবে ভারতে ‘খেলা হবে’স্লোগানটি যাঁর মুখে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেই তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অনুব্রত মণ্ডল দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) দুর্নীতি মামলায় এখন কারাগারে।