রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গতকাল দুটি দল ও একটি জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এসব দল রাষ্ট্রপতিকে সরানোর ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে। তবে এর প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছে তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা গতকাল সোমবার আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণ অধিকার পরিষদের একাংশ ও ছয়টি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃত্বের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা তাঁকে অপসারণে ছাত্রনেতাদের দাবির সঙ্গে একমত বলে জানিয়েছে।
তবে এই জোট এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। জোটের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সে জন্য প্রয়োজনে সময় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে এই জোট। গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু অপসারণের প্রশ্নে জটিলতার কথা এসেছে, সে কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য হতে হবে।
গতকাল সন্ধ্যার পর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নাগরিক ঐক্যের কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যৌথ প্রতিনিধিদলের এই বৈঠক হয়। বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকিসহ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘চুপ্পুর (রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের ডাকনাম) অপসারণের বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে। এ বিষয়ে তারা রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা বলেছে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এটাও বলেন, ‘বিগত তিনটি নির্বাচনের বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যেই আলোচনা চলমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে তাঁরা একমত হতে পারেননি। ঐকমত্য হলে তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে জানাবেন। প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয়ে তাঁরা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা আশঙ্কা করেছেন, এতে মুক্তিযুদ্ধ নেগেশন (অস্বীকার করা) হয় কি না। আমরা তাঁদের বলেছি, একাত্তর ও চব্বিশকে আমরা সংশ্লেষণ ঘটাব। আমরা বলার পর তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছেন।’
এবি পার্টি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরানোর পক্ষে রয়েছে। তবে দলটি ছাত্রনেতাদের এ ব্যাপারে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। গতকাল দুপুরে বিজয়নগরে এবি পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে ওই পরামর্শ দেয় দলটি।
বৈঠক শেষে এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠিয়ে মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে বিদায় না করলে তা জাতীয় জীবনের মহাসংকট হিসেবে থাকবে।
দলের এ অবস্থানের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও উপদেষ্টামণ্ডলী সুপ্রিম কোর্টে একটা রেফারেন্স পাঠিয়ে তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে শপথ নিয়েছেন। এটা কিন্তু একটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের যে বিধানমতে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে রেফারেন্স নেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে সে রকম একটা রেফারেন্স নিয়ে একটা সমাধানে আসা যেতে পারে। তাহলে সাংবিধানিক সংকট বা শূন্যতা থাকবে না বলেই আমরা মনে করছি৷’
যেহেতু বিএনপিসহ কিছু দল রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এবি পার্টি সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছে বলে দলটির নেতারা বলছেন।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, ‘একটা রাষ্ট্রে বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে অনেক সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে নেওয়া যায় না৷ সে সময় যে একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল, নানা কারণে তখন তা নেওয়া যায়নি। ফলে একটা বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে, অবৈধ রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নেওয়াটা বৈধ হয়েছে কি না৷ আমরা মনে করি, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু রাষ্ট্রপতি নিজেই নিজের পূর্ববর্তী বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিয়ে একটা বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। সেই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন।’
এবি পার্টির পক্ষে বৈঠকে অংশ নেন দলের সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, দপ্তর সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, প্রচার সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল, জ্যেষ্ঠ সহকারী সদস্যসচিব এ বি এম খালিদ হাসানসহ কয়েকজন নেতা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের একাংশের বৈঠক হয় গতকাল বিকেলে। সেই বৈঠকের পর দলটির সদস্যসচিব ফারুক হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে আমরা শতভাগ একমত হয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, গণ অধিকার পরিষদের এই অংশ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে অবিলম্বে অপসারণের পক্ষে মত দিয়েছেন। বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনার বিষয়েও তাঁরা একমত পোষণ করেছেন।
বৈঠকে গণ অধিকার পরিষদের এই অংশের প্রধান উপদেষ্টা রেজা কিবরিয়া, আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান, উচ্চতর পরিষদের সদস্য শিরিন আক্তারসহ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল দলগুলোর সঙ্গে তিনটি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার সেক্রেটারি আরিফুল ইসলাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সদস্যসচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম।
গত পাঁচ দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ছয়টি দল ও দুটি জোটের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করল। তারা এ আলোচনা অব্যাহত রাখার কথা বলেছে।