বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস জামিন আবেদন দুই দফা নাকচ হয়েছে। গতকাল বুধবার আবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন আবেদন করা হয়। আদালত আজ শুনানির দিন রেখেছেন।
আইনজীবী ও পারিবারিক সূত্র জানায়, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে গত ১০ বছরে ৯২টি মামলা হয়েছে। ফলে প্রতি মাসেই তাঁকে মামলার হাজিরা দিতে ঢাকার আদালতে যেতে হয়। সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর ঢাকার আদালতে দুটি মামলায় হাজিরা দিয়েছেন তিনি। এরপর ওই দিন গভীর রাতে তাঁকে বাসা থেকে তুলে আনা হয়। পরে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ নিয়ে তিনি কারাগারে গেছেন অন্তত পাঁচবার। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫০ দিনের মতো জেল খেটেছেন।
ফখরুলের মামলা পরিচালনাকারী তিন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির মহাসচিবের বিরুদ্ধে যে ৯২টি মামলা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এখন সচল আছে ২০ থেকে ২৫টি। বাকি মামলার বেশির ভাগ উচ্চ আদালতের আদেশে বিচার কার্যক্রম স্থগিত আছে। কয়েকটি মামলায় তিনি আদালতের আদেশে অব্যাহতিও পেয়েছেন। সর্বশেষ নাশকতার অভিযোগে হাতিরঝিল থানায় করা একটি মামলায় অব্যাহতি পান মির্জা ফখরুল।
মির্জা ফখরুলের আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য বিএনপির মহাসচিবের বিরুদ্ধে একের পর এক সরকার মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বেশির ভাগ মামলা উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। সর্বশেষ তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
তবে ঢাকা মহানগরের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, পল্টনের নাশকতার ঘটনাটি দৃশ্যমান। পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে দাবি করেন পিপি।
ঢাকার আদালতে বিচারাধীন ২০টি মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত পাঁচ মাসে হাজিরা দিয়েছেন অন্তত ২২ দিন। বিচারিক আদালতে ফখরুলের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও সৈয়দ জয়নুল আবেদিন প্রথম আলোকে বলেন, মির্জা ফখরুলকে প্রতি মাসে ঢাকার আদালতে একাধিক দিন আসতে হয় মামলার হাজিরা দিতে। কোনো কোনো মাসে পাঁচবারও আসতে হয়। এর আগে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে প্রতি সপ্তাহে হাজিরা থাকত। তবে তিনি নিয়ম মেনে আদালতে হাজিরা দিয়ে গেছেন।
মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মানহানির দুটি মামলা ছাড়া ফখরুলের অন্য মামলাগুলোর বেশির ভাগই পুলিশের করা। মামলায় ফখরুলের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, গাড়ি ভাঙচুর ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিচারাধীন মামলার মধ্যে ২০১২ সালে করা মামলার সংখ্যা ৭। বাকি মামলাগুলো ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে হয়েছে।
মির্জা ফখরুল ইসলামের স্ত্রী রাহাত আরা বেগমের মতে, তাঁর স্বামীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার (ফখরুল) বিরুদ্ধে ময়লার গাড়ি পোড়ানোর মামলা দেওয়া হয়েছে। উনি ময়লার গাড়ি পোড়াবেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? উনি তো খুব অসুস্থ। ওনার বয়স হয়েছে, হার্টে ব্লক আছে। মস্তিষ্কের বাঁ পাশসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা রয়েছে। আমরা আশা করি, উনি দ্রুত আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাবেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন।’
বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর ২০১১ সালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়। ২০১৬ সালে দলের জাতীয় সম্মেলনে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন থেকে তিনি মহাসচিব পদে আছেন।
মির্জা ফখরুল ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে ঢাকা কলেজসহ কয়েকটি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে সরকারি চাকরি ছেড়ে আশির দশকে পুরোপুরি রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে তিনি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে গত ১০ বছরে ৯২টি মামলা দেওয়া প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে যত মামলা, তাঁকে আপাতদৃষ্টিতে ভয়ংকর অপরাধী মনে করা স্বাভাবিক। তবে মির্জা ফখরুল একজন সজ্জন ও ভালো রাজনীতিক হিসেবে সমাজে পরিচিত। এমন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা দেওয়া অমানবিক।