খালেদা জিয়ার রাজনীতি

হঠাৎ কেন বিষয়টি সামনে আনল সরকার, প্রশ্ন ও সন্দেহ বিএনপিতে

খালেদা জিয়া
 ফাইল ছবি

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে পারা না–পারা প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতাদের অনেকে। তাঁরা বলেছেন, এর পেছনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেছেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না—তাঁর মুক্তির সময় এমন কোনো শর্ত সরকার দেয়নি। কিন্তু বিএনপি নেতাদের অনেকে বলেছেন, মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য নিয়ে তাঁদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, হঠাৎ করেই খালেদা জিয়ার রাজনীতির বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তোলা হচ্ছে।

এমন সন্দেহের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, এর আগেও বিভিন্ন সময় সাংবাদিকেরা এ ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন। তাতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেকেই বলে আসছিলেন যে অসুস্থতার জন্য মানবিক কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া মুক্ত রয়েছেন। ফলে বিএনপি নেত্রী অন্য কোনো কর্মকাণ্ড চালাতে পারবেন না।

কিন্তু এখন আইনমন্ত্রী ভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন বলে বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সরকারের উদ্দেশ্য কী, তা নিয়েই আমাদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।’

খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে পারা না–পারার বিষয়টি হঠাৎ করেই গত জানুয়ারি মাসে সামনে নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে তিনি দাবি করেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা রয়েছে। যদিও তখন বিএনপি তাঁর এ বক্তব্য সত্য নয় বলে জানিয়েছিল। শেখ সেলিমও তাঁর দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। কিন্তু বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তৈরি করেছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাঁকে ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল মুক্তি দেয় সরকার। তখন দেশে করোনাভাইরাস মহামারি চলছিল। ওই সময় যে দুটি শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে পারবেন না। দেশে থেকে বাসায় চিকিৎসা নেবেন। এর পর থেকে খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাস পরপর তাঁর মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।

সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির ক্ষেত্রে ওই দুটি শর্তের কথা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এখানে রাজনীতি করতে না পারার কোনো বিষয় নেই।

গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না, তাঁর মুক্তির ক্ষেত্রে এমন কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার প্রশ্নে সরকার কোনো বাধাও সৃষ্টি করেনি। তবে দুর্নীতির মামলায় সাজা থাকায় খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন না।

কিন্তু লিখিত কোনো শর্ত না থাকলেও খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলে তাঁর মুক্ত থাকার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার কথা বলে তাঁর ছোট ভাই মানবিক কারণ দেখিয়ে সরকারের কাছে মুক্তির আবেদন করেছিলেন। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা ক্ষমতাবলে নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং মানবিক কারণে মুক্তি চেয়ে যে আবেদন করা হয়েছিল, এখন তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলে পরিবারের সেই আবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

আইনমন্ত্রী মনে করেন, গুরুতর অসুস্থ থাকলে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেন না। ফলে রাজনীতিতে সক্রিয় হলে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে কি না, এ প্রশ্নও সামনে আসবে।  

মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা ধারণা করা যায় যে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলে তাঁকে আবার জেলে পাঠানোর সুযোগ থাকবে সরকারের কাছে।

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের কয়েক দিন আগে দলটির একাধিক নেতা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া ওই সমাবেশে যোগ দিতে পারেন। তখন সরকার ওই সমাবেশ নিয়ে কঠোর অবস্থানে গিয়েছিল। বিএনপি যেখানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল, সেই জায়গায় সরকার অনুমতি দেয়নি। এমনকি ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের ৪৮ ঘণ্টা আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করেছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দল এবং জোট যুগপৎ আন্দোলন করছে, সেই আন্দোলনে লোকসমাগম বাড়ছে। এ আন্দোলনের কোনো এক পর্যায়ে খালেদা জিয়াকে রাজপথে হাজির করা হয় কি না, এমন সন্দেহ সরকার এবং আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকতে পারে। সে কারণে সরকার খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার বিষয়টি এখনই সামনে নিয়ে আসছে।