ভোটের আগে রাজপথের কৌশল পাল্টাচ্ছে আওয়ামী লীগ

নির্বাচনী আমেজ আনার লক্ষ্য থেকে আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কিছু বড় জমায়েত করবে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের লোগো

বিএনপির কর্মসূচিতে ‘সতর্ক পাহারার’ নামে পাল্টা কর্মসূচি রেখে রাজপথে অবস্থানের যে কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, সেই কৌশল পাল্টাচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা। দলটি এখন সরাসরি পাল্টা কর্মসূচি দেওয়ার চেয়ে নিজেরা বড় জমায়েতের সমাবেশ করার ব্যাপারে জোর দিচ্ছে।

মূলত নির্বাচনী আমেজ আনার লক্ষ্য থেকে আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কিছু বড় জমায়েত করবে দলটি। এসব সমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে তাদের এমন কৌশলের কথা জানা গেছে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ (উড়ালসড়ক) বড় কিছু উন্নয়ন প্রকল্প চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এসব প্রকল্পের উদ্বোধনকে ঘিরে সুধী সমাবেশ বা সমাবেশে বড় জমায়েত করার পরিকল্পনা করেছে ক্ষমতাসীন দল। এসব সমাবেশের সাজসজ্জা, ব্যানার ও নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণে নির্বাচনী আমেজ আনার চেষ্টা থাকবে। এ ছাড়া দলের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে রাজনৈতিক সমাবেশ বা জনসভা করা হবে বলে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে।

কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক
বিএনপির আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়। আওয়ামী লীগ এখন থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।
আব্দুর রাজ্জাক, কৃষিমন্ত্রী ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ

নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে প্রথম সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হবে। ওই দিন ঢাকার উড়ালসড়কের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশ চালু করে আগারগাঁওয়ে সমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এটি হবে সুধী সমাবেশ। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সুধী সমাবেশেই কয়েক লাখ লোকের জমায়েত নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু রাজধানী নয়, ঢাকা জেলা এবং আশপাশের জেলা থেকেও নেতা-কর্মীদের আনা হবে।

এর আগে ১ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সমাবেশ রয়েছে। সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মীদের এনে বড় জমায়েত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠন। এই সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এভাবে আগামী দুই মাসে গোটা দশেক এ ধরনের সমাবেশের পরিকল্পনা আছে আওয়ামী লীগের।

আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আগারগাঁওয়ে ‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড়’ সমাবেশ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, পাল্টা কর্মসূচি নয়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রাজপথে আছে। প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশগুলোও নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ।

গত ডিসেম্বর থেকেই আওয়ামী লীগ ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আছে। তবে এখন সেই কৌশলে পরিবর্তন এনে আওয়ামী লীগ কেন বড় সমাবেশে জোর দিচ্ছে? এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বড় বড় সমাবেশ করার চিন্তার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, দেশে-বিদেশে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের জনসমর্থন দেখানো।

প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আগারগাঁওয়ে ‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড়’ সমাবেশ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম

সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) এক জনমত জরিপে এসেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ৭০ ভাগ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের নেতারাও বলে আসছেন, দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকেই চায়। জনসমর্থন নিয়েই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। বিদেশি সংস্থার জরিপ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের সত্যতা আছে—বিষয়টি দেখাতেও বড় সমাবেশের দিকে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ।

আইআরআই জনমত জরিপটি প্রকাশ করা হয়েছে ৮ আগস্ট। গত ১ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়। এই জরিপেই বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ মনে করেন, দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। তাঁদের এমন ধারণার পেছনে কারণ হিসেবে এসেছে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও বাক্‌স্বাধীনতার প্রশ্নসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি। অবশ্য আওয়ামী লীগ জরিপের এই অংশ সামনে আনছে না।

একের পর এক প্রকল্পের উদ্বোধন

আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার আগে মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মার দুই পারে রেললাইন চালু, কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইনের উদ্বোধনসহ গোটা দশেক উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে।

সরকার ও আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বিদেশ সফরের ফাঁকে ফাঁকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন করা হবে। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের পর রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এর বাইরে সিলেট, বরিশাল ও খুলনায় বিভাগীয় সমাবেশ করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। সময় পেলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জেলাতেও কর্মসূচি নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ২ আগস্ট রংপুরে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় মহাসমাবেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতি ছিল, যা পরবর্তী সময়ে দলের নির্বাহী কমিটি এবং বিশেষ বর্ধিত সভায়ও আলোচনায় এসেছে। এ সমাবেশ সফল করতে কেন্দ্রীয় নেতা, একাধিক মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতারা দুই সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন। এভাবে প্রতিটি সমাবেশেই বিপুলসংখ্যক জমায়েত নিশ্চিত করার বিষয়ে দলীয় নির্দেশনা আছে।

পাল্টা কর্মসূচি থেকে সরে আসার তিন কারণ

বিএনপির কর্মসূচিতে সরাসরি পাল্টা কর্মসূচি নেওয়া থেকে কিছুটা সরে আসার পেছনে তিনটি কারণের কথা বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

প্রথমত, শোকের মাস আগস্টে আওয়ামী লীগ নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। এ ছাড়া আগস্টে কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক—এটা চায়নি আওয়ামী লীগ। এ জন্য পাল্টা কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। তবে শোকের মাসের নানা কর্মসূচি ঢাকাসহ সারা দেশেই হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এত দিন বিএনপির কর্মসূচির দিনই বড় কর্মসূচি পালনে রাজপথে উত্তাপ সৃষ্টির বিষয়টি সমালোচনা এড়ায়নি। দেশের পাশাপাশি বিদেশি কূটনীতিকেরাও বিষয়টি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে। এ জন্য সমালোচনা কিছুটা চাপা দিতে আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি থেকে বিরতি দেয়।

 ২ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের শীর্ষ নেতারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই দিনের বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্পষ্ট করে জানতে চেয়েছেন, বিএনপির কর্মসূচির দিন পাল্টা কর্মসূচি কেন নেয় আওয়ামী লীগ। এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করে এবং তা এড়ানো যায় কি না—সেই প্রশ্ন করেন পিটার হাস। এ ছাড়া পশ্চিমা কূটনীতিকেরাও বিষয়টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে একাধিকবার তোলেন। দেশেও গণমাধ্যমে বারবার পাল্টা কর্মসূচির বিষয়ে জবাব দিতে হয়। এ জন্যই আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি থেকে কিছুটা সরে এসেছে।

তৃতীয়ত, বিএনপির কর্মসূচি কিছুটা ঢিলেঢালা হওয়ার কারণেও আওয়ামী লীগ এখন এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। গত ২৮ জুলাই বড় মহাসমাবেশ করার পরদিন বিএনপি ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেয়। ওই দিন আওয়ামী লীগও ‘সতর্ক পাহারার’ নামে রাজপথে অবস্থান নেয়। মাতুয়াইল, ধোলাইখালসহ কয়েকটি স্থানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। যানবাহন পোড়ানো ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তি প্রয়োগের ফলে বিএনপি ওই দিন দাঁড়াতে পারেনি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিষয়টিই ফলাও করে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি ওই ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেনি। তারা এখন যেসব কর্মসূচি দিচ্ছে, সেগুলো এতটা জোরদার নয়। জমায়েতও নামমাত্র। এমন পরিস্থিতিতে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থেকে বদনাম কুড়াতে চায় না আওয়ামী লীগ।

বিএনপি ও বিভিন্ন দল এবং জোট যুগপৎ আন্দোলন শুরুর পর থেকেই সরকার ও আওয়ামী লীগের ভেতরে একটা আশঙ্কা কাজ কা হচ্ছে যে দলটি বিপুল সংখ্যায় লোক নিয়ে ঢাকার রাজপথে বসে পড়ে কি না। একবার তারা বসে পড়লে ঢাকা অচল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। এ জন্যই মূলত পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, আগস্টে বিএনপি বসে পড়ার চেষ্টা করবে না—এ খবর সরকারের কাছে আছে। সেপ্টেম্বরও হয়তো দলটি আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে। যখন মনে হবে বিএনপি সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে, তখনই আবার রাজপথে আওয়ামী লীগ পূর্ণ শক্তি নিয়ে নামবে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও আগের চেয়ে বেশি তৎপর থাকবে। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করবে না।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়। আওয়ামী লীগ এখন থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বিএনপি যদি জ্বালাও-পোড়াও বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়, তখন আওয়ামী লীগ তা প্রতিহত করবে।