আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাই করতে সর্বশেষ ছয়টি জরিপ বিশ্লেষণ করছে আওয়ামী লীগ।
১০০-এর বেশি দলীয় মন্ত্রী-সংসদ সদস্য মনোনয়ন থেকে বাদ পড়তে পারেন, এমন আলোচনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তৃণমূলের বিরোধ প্রকট। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলের ভেতরে কোন্দল মিটিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিষয়কে বড় কঠিন কাজ হিসেবে দেখছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা। নতুবা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের পর দলের বিরোধ আরও বাড়তে পারে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়েছে গত রোববার হয়ে যাওয়া বিশেষ বর্ধিত সভায়। আওয়ামী লীগের এই সভায় সারা দেশ থেকে আসা সব স্তরের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। দিনভর এই সভায় তৃণমূলের ৪৩ জন নেতা বক্তৃতা করেন। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের বক্তব্যে তৃণমূলের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দূরত্ব ও মাঠপর্যায়ে বিভেদের কথা এসেছে। অনেকেই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও বিবেচনার আহ্বান জানান দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পাঁচ নেতার সঙ্গে গতকাল সোমবার কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরাও দলের বিভেদকে চিন্তার কারণ হিসেবে দেখছেন বলে জানান। তবে তাঁরা এ–ও মনে করেন, গণভবনের বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতারা দুঃখ, কষ্ট ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলায় কিছুটা লাভ হয়েছে। ফলে দ্বন্দ্ব মিটে না গিলেও ক্ষোভ প্রশমন হয়তো হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দলে দ্বন্দ্ব-কোন্দল আছে, এটা ঠিক। তবে ভোটে আওয়ামী লীগের সবাই নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবেন।
সোমবার তৃণমূলের যেসব নেতা গণভবনে বর্ধিত সভায় অংশ নেন, তাঁদের সাতজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মূল বক্তব্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে বিপুল উন্নয়ন করেছে। কিন্তু দলের জনপ্রতিনিধিদের জনপ্রিয়তা নেই। দলের মধ্যে বিভেদও প্রকট। এটাই বড় চিন্তার কারণ।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এবার নির্বাচন ঘিরে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে একক প্রার্থী রাখা কঠিন হবে। তখন দলের ভেতর থেকেই একাধিক নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরও বাড়বে। এ ছাড়া বিএনপিবিহীন ভোটে অন্যান্য দলকে নির্বাচনে আনতে কিছু আসনে ছাড় দিতে হবে। বিএনপি থেকে দলছুট নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে উৎসাহ দেওয়া হবে। তখন কোন আসনে কে ছাড় দেবে—এই নিয়ে বিরোধ হতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, বিএনপি ভোটে এলে দলীয় মনোনয়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। কেননা, বর্তমান মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অনেককেই নিজ আসনের ভোটাররা পছন্দ করেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটে জয় পেতে হলে যেনতেন প্রার্থী দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনের আগে দলে তৃণমূলের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দূরত্ব, বিরোধ মেটানোর বিষয়কে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম রোববার গণভবনের সভায় বক্তৃতা করেছিলেন। ওই দিন তিনি বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দ্বন্দ্ব আছে। আজ আমাদের দল দুই ভাগে বিভক্ত—একটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আরেকটা আমি লীগ।’
দলের দ্বন্দ্ব ও আগামী নির্বাচন নিয়ে গতকাল জানতে চাইলে শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আছে। বিপুল উন্নয়ন করেছে। আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করা কঠিন হবে না। তবে এর জন্য পূর্ব শর্ত হচ্ছে— দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে যাচাই-বাছাই করে।
বর্ধিত সভায় অংশ নেওয়া একাধিক সূত্র জানায়, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান গত মে মাসে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁর পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দলকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, দলের ভেতর অনেকেই অন্যকে ‘সাইজ’ করার রাজনীতি করেন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আজমত উল্লা যে বিভাজনের কথা বলেছেন, তা আগামী নির্বাচনের আগে মিটে যাবে—এমনটা মনে করা কঠিন।
বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দ্বন্দ্ব আছে। আজ আমাদের দল দুই ভাগে বিভক্ত—একটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আরেকটা আমি লীগ।যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম
বর্ধিত সভার সমাপনী বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তিনি তাঁর পক্ষে থাকার বিষয়ে হাত তুলে ওয়াদা করিয়েছেন সবাইকে।
বর্ধিত সভার সূত্র জানায়, অনৈক্যের কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা ওই সভায় বলেন, ‘অনেকে মনোনয়ন না পেয়ে দলের হয়ে কাজ করে না। তারা মনে করে একটা আসন না পেলে কী হবে? বাকি আসন তো পাওয়া যাবে। ক্ষমতায় তো দল যাবেই। প্রার্থীকে হারিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দেখান অনেকে। এভাবে ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে দলকে ক্ষমতা হারাতে হয়।’
গণভবনের বর্ধিত সভায় উপস্থিত সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দলীয় মনোনয়ন ঠিক করতে তিনি ছয় মাস পরপর জরিপ পরিচালনা করেন।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাই করতে সর্বশেষ ছয়টা জরিপের ওপর বিশ্লেষণ চলছে। এসব জরিপের সব গড় করে জানা গেছে ১০৩ জন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের প্রাপ্ত নম্বর খুবই কম।
এ পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনেকে বাদ পড়তে পারেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক।
সূত্র বলছে, জরিপ মেনে হয়তো সবাইকে বাদ দেওয়া সম্ভব হবে না। দু-চারজন নানা যোগাযোগ এবং ক্ষমতার বলে টিকে যাবেন। রাজনৈতিক নানা মেরুকরণের কারণে ভালো নম্বর পাওয়া কিছু কিছু মন্ত্রী-সংসদ সদস্যও বাদ পড়তে পারেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০০ জনের বেশি মন্ত্রী–সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন পাওয়া থেকে বাদ পড়তে পারেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সে সময়ের ৫৬ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্য মনোনয়ন পাননি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন ছয়জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৯ জন সংসদ সদস্য।
রাজনৈতিক নানা মেরুকরণের কারণে ভালো নম্বর পাওয়া কিছু কিছু মন্ত্রী-সংসদ সদস্যও বাদ পড়তে পারেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১০০ জনের বেশি মন্ত্রী–সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন পাওয়া থেকে বাদ পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও দলের সংসদীয় বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, দ্বন্দ্ব-কোন্দল এবং মনোনয়ন নিয়ে যে দুঃখ-কষ্টের বিষয়গুলো এসেছে, এর কিছু কিছু ভিত্তি আছে। তিনি উল্লেখ করেন, শোকের মাসের কর্মসূচি শেষে দল এসব বিষয় নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকেরা আলোচনা করবেন। কোথাও সমস্যা থাকলে তা নিরসনে চেষ্টা করা হবে। তবে দিন শেষে সবার লক্ষ্য একটাই—তা হলো দলীয় ঐক্য। দল যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করবে, আর নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব হচ্ছে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, তাঁকে জয়ী করা। এর কোনো বিকল্প নেই।