জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট নির্বাচন কমিশনে বসে পর্যবেক্ষণ করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্য কর্মকর্তারা। নির্বাচন কমিশন ভবন, আগারগাঁও, ১৭ অক্টোবর
জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট নির্বাচন কমিশনে বসে পর্যবেক্ষণ করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্য কর্মকর্তারা। নির্বাচন কমিশন ভবন, আগারগাঁও, ১৭ অক্টোবর

বিনা ভোটে ২৫টিসহ ৪৯ চেয়ারম্যান পদে জয় আওয়ামী লীগের

৫৯টি জেলা পরিষদের নির্বাচনে ৪৯টিতেই চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীরা। এর মধ্যে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন ২৫ জন। আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পেয়েছেন ৬ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির (জাপা) একজন চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। আর কোনো দলের সমর্থন ছাড়া স্বতন্ত্র ৩ জন প্রার্থী জয় পেয়েছেন।

গতকাল সোমবার দ্বিতীয়বারের মতো জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নির্দলীয় হলেও আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়ারম্যান পদে দলীয় সমর্থন ঘোষণা করেছিল। এমনকি দল–সমর্থিত প্রার্থীদের নামও প্রকাশ করেছিল।

তিন পার্বত্য জেলা বাদে দেশের ৬১টি জেলা পরিষদে ১৭ অক্টোবর (গতকাল) ভোট গ্রহণের জন্য তফসিল ঘোষণা করেছিল ইসি। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলা পরিষদের নির্বাচন আদালতের নির্দেশে স্থগিত করা হয়।

আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীদের একতরফা বিজয়ের মধ্যেও কক্সবাজার, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, রংপুর, শেরপুর ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীদের হারিয়ে জয় পেয়েছেন বিদ্রোহীরা।

ফেনী ও ভোলা জেলা পরিষদে চেয়ারম্যানসহ সব পদেই একক প্রার্থী থাকায় সেখানে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। বাকি ৫৭টি জেলা পরিষদে গতকাল সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ভোট হয় ৩৪টি জেলা পরিষদে। একক প্রার্থী থাকায় চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়নি ২৫ জেলায়।

জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এবার নির্বাচন নিয়ে অস্থিরতা থাকলেও ভোটের দিন ছিল শান্তিপূর্ণ। বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি ঘটনা ছাড়া ভোটের পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। ভোট নেওয়া হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছিল সিসি ক্যামেরা। রাজধানীর নির্বাচন ভবন থেকে সিসিটিভিতে সরাসরি ভোট পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

ভোট গ্রহণ শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে কোথাও অনিয়ম, সহিংসতা, গোলযোগ বা গন্ডগোলের তথ্য পাওয়া যায়নি। নির্বাচন নিয়ে কমিশন সন্তুষ্ট। গাইবান্ধা–৫ আসনের উপনির্বাচনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের ইতিবাচক প্রভাব জেলা পরিষদের নির্বাচনে পড়েছে বলেও তিনি মনে করেন।

সিইসি বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে কোথাও গোপন বুথে ভোটার ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি দেখা যায়নি। সিসিটিভির মাধ্যমে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন পরিচালনায় একটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। এটি ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দেবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, গাইবান্ধা–৫ আসনের উপনির্বাচনে সিসিটিভির মাধ্যমে ইসি পর্যবেক্ষণ করে। সেখানে বেশ কিছু গুরুতর অনিয়ম দেখা যায়। কমিশন পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছিল। সেখান থেকে হয়তো একটি বার্তা এসেছে। এর একটি ইতিবাচক প্রভাব জেলা পরিষদ নির্বাচনে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের বিষয়টি নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ইসি এখনো এই বিশ্লেষণে যায়নি। আর এটি ইসির বিষয় নয়, ইসি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে না।

আরেক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সংসদ সদস্যরা জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রে গেছেন, তাঁদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। বড় পরিসরের নির্বাচনে সিসিটিভির ব্যবহার প্রশ্নে তিনি বলেন, ছোট পরিসরে এবার সিসিটিভি ব্যবহার করা হয়েছে। বড় পরিসরের নির্বাচনে বড় সক্ষমতা তৈরির চেষ্টা ইসির থাকবে।

বিদ্রোহীরা জয়ী যেখানে

আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীদের একতরফা বিজয়ের মধ্যেও কক্সবাজার, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, রংপুর, শেরপুর ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীদের হারিয়ে জয় পেয়েছেন বিদ্রোহীরা। দিনাজপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টি–সমর্থিত প্রার্থী। আর নরসিংদী, পঞ্চগড় ও পটুয়াখালী জেলা পরিষদে জয়ী প্রার্থীরা কোনো দলের সমর্থিত বা বিদ্রোহী ছিলেন না। এই ১০টি জেলা বাদে অন্য জেলা পরিষদগুলোতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীরা।

ইভিএমে বিড়ম্বনা

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে সন্দ্বীপ কেন্দ্রে ইভিএমে কারিগরি ত্রুটির কারণে অন্তত ২০ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। জানা গেছে, প্রথম ভোটার ভোট দিতে গেলে ইভিএমের ব্যালট অংশে লাইট দেখা যাচ্ছিল না। বিষয়টি জানানোর পর ওই যন্ত্রটি পরিবর্তন করা হয়। তবে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মেজবাউল করিম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ভোট গ্রহণে পাঁচ থেকে সাত মিনিট দেরি হয়েছে।

ব্রা‏হ্মণবাড়িয়ার কসবা কেন্দ্রে ইভিএমে ত্রুটির কারণে ভোট গ্রহণে দেরি হয়। কসবার গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান ভূঁইয়া ও বিনাউটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. জুয়েল মিয়া ভোট দিতে গেলে ইভিএমে তাঁদের আঙুলের ছাপ মিলছিল না। পরে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে তাঁদের দুজনের জন্য আরেকটি ইভিএম এনে ভোট নেওয়া হয়। এতে ভোট গণনা শুরু করতে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা দেরি হয়।

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষের ভোটকেন্দ্রে একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলায় এক ঘণ্টা দেরিতে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তিলকপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সেলিম রেজা ভোট দিতে যান। কিন্তু নানা চেষ্টা করেও তাঁর আঙুলের ছাপ মিলছিল না। পরে ইসিকে ঘটনাটি জানানো হয়। ইসি থেকে ‘পিন কোড’ দেওয়ার পর তিনি ভোট দেন। সেখানে বেলা তিনটায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়।

প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলেনি। নির্বাচন কমিশন থেকে পিন কোড এনে তাঁকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ কারণে ভোট গ্রহণ এক ঘণ্টা দেরিতে শেষ হয়।

কুমিল্লা জেলা পরিষদ নির্বাচনে লালমাই উপজেলা কেন্দ্রে ১০ মিনিট দেরিতে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ইভিএমে সময় নির্ধারণ করা থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. জোনায়েদ কবির খান।

ছাত্রদল নেতাকে মারধর

নাটোর জেলা পরিষদ নির্বাচনে বাগাতিপাড়ায় ভোটকেন্দ্রের পাশে আওয়ামী লীগের সদস্য প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ছাত্রদল নেতাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে বাগাতিপাড়া উপজেলার প্যারাবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশে এ ঘটনা ঘটে। মারধরের শিকার ছাত্রদল নেতা মাহফুজুর রহমান উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বিএনপির সদস্য প্রার্থী সেলিম রেজার সমর্থক।

বরিশাল জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। মেয়রের নিজের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।

নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ ছাড়া নির্বাচনের আগের রাতে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলায় দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। গত রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপজেলার করফা বাজার এলাকায় এই সংঘর্ষে একজন সদস্য প্রার্থীসহ পাঁচজন আহত হন।