অদৃশ্য একটি শক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কাজে হস্তক্ষেপ করছে বলে মনে হচ্ছে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের। তিনি বলেছেন, ‘যাঁরা উপদেষ্টা আছেন, তাঁদের সম্বন্ধে আমি জানি। তাঁরা অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, তাঁরা দেশের স্বার্থেই কাজ করছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, একটি অদৃশ্য শক্তি আছে, যারা উপদেষ্টাদের কাজে হস্তক্ষেপ করছে। দেশের অর্ধেক মানুষের বিরুদ্ধে অর্ধেক মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে।’
আজ মঙ্গলবার দুপুরে জাপার বনানীর কার্যালয়ে জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জি এম কাদের এ কথা বলেন।
দেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে জি এম কাদের বলেন, দেশকে শুধু দুই ভাগ করা হয়নি, এক ভাগকে অন্য ভাগের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেশে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও বিচার বিভাগ যেন বাধ্য হয়ে তাদের (অদৃশ্য শক্তি) সহায়তা করছে। এমন বাস্তবতায় কখনোই দেশে স্থিতিশীলতা আসতে পারে না। যেকোনো সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এমন একটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা আছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন জাপার চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারকে সহায়তা করতে চেয়েছি। শুনলাম তারা আর সংস্কার করতে পারছে না, তারা একটি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করছে। কারণ, সংস্কার করতে হলে সংসদে যেতে হবে। সব দলের সহযোগিতা ছাড়া সংস্কার সংসদে পাস করা যাবে না। এখন নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কি না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সমান সুযোগ) পাব, এটা আমরা মনে করতে পারছি না।’
জি এম কাদের বলেন, ‘নির্বাচনে আমরা যেতে চাই। কিন্তু নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাব কি না, দেখতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো দল থাকতে পারবে না। তাদের কোনো দল থাকলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ব্যত্যয় ঘটায়। আমি দাবি জানাচ্ছি, আমাদের নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন, আমাদের অধিকার অনুযায়ী রাজনীতি করতে দিন। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না। দেশকে ভাগ না করে ঐক্যবদ্ধ করুন। আমরা সবাই মিলে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই।’
এখনো জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে, এখনো অনেকে জেলে আছেন, সভা–সমাবেশ করতে গেলে বাধা দেওয়া হচ্ছে, দলীয় কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জি এম কাদের।
জি এম কাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিজের ভূমিকার কথা আবারও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে আমরা আগাগোড়া জড়িত ছিলাম। সংসদে এবং সংসদের বাইরে আমি তাদের পক্ষে কথা বলেছি। এই আন্দোলনে আমাদের নেতা-কর্মীরা অংশ নিয়ে জীবন দিয়েছে, জেল খেটেছে। অন্তত চার বছর আগে থেকে আমি অনেক ঝুঁকি নিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। এখন আমি এবং আমার দল কীভাবে দেশদ্রোহী হলাম, সেটাই বুঝতে পারছি না।’
জি এম কাদের আরও বলেন, ‘যারা শেখ হাসিনার দেওয়া মিথ্যা মামলায় পলাতক ছিল, তাদেরও এখন হত্যা মামলায় আমার সঙ্গে আসামি করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা বাদী প্রত্যাহার করেছে; কিন্তু একটি দলের আইনজীবীরা চাপ সৃষ্টি করেছে, গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নাম দিতে হবে। অবস্থা এমন যে ওনাকে (জি এম কাদের) জেলে দিতে হবে, ফাঁসি দিতে হবে। অথচ যে দলই নির্যাতিত হয়েছে, আমি তাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে বিচার বিভাগের সবাই জানে এগুলো মিথ্যা মামলা। কিন্তু তারা মেনে নিচ্ছে।’
বিচারের নামে কোনো প্রহসন দেখতে চান না জানিয়ে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করেন জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘আজ আপনি ক্ষমতায় আছেন, একটি হত্যা মামলা ধামাচাপা দিতে পারেন। ১০-১৫ বছর পর যখন আপনি ক্ষমতায় থাকবেন না, তখন আবার ঠিকই সেই মামলা সামনে চলে আসবে। শহীদদের আত্মত্যাগকে মিথ্যা মামলা বানিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। শহীদদের হত্যা মামলা নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। ব্যক্তিগত শত্রুতা উদ্ধারে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য প্রতিশোধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান কোনো দিনই অস্বীকার করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন জাপার চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, যে জনতা ছাত্রদের এই যৌক্তিক আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল তাদের অবদানও অস্বীকার করা যাবে না।
বক্তব্যের শুরুতে জি এম কাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানান। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ছাত্র-জনতার প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জানান তিনি।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংস্কৃতিক পার্টির সভাপতি শেরীফা কাদেরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন জাপার জ্যেষ্ঠ কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কো–চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার।
সাংস্কৃতিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, নাজমা আখতার, লিয়াকত হোসেন, এইচ এম শাহরিয়ার আসিফ প্রমুখ।