দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল বিভিন্ন দল ও জোট। নির্বাচন বর্জন করে সরকার পতনের লক্ষ্যে এসব দল ও জোটের যুগপৎ আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হয়। কারণ, আন্দোলনের মুখেও আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন করতে পেরেছে। এখন সরকারবিরোধীদের যুগপৎ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হওয়ার পর ছয় মাস পেরোলেও সরকারবিরোধীরা যুগপৎ কোনো কর্মসূচি দেয়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এখন যুগপৎ আন্দোলন নেই।’ তাঁর এমন বক্তব্যের পরে যুগপৎ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী হবে, সে প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে।
মাহমুদুর রহমান গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জাতি দাবি করছে সর্বব্যাপী ঐক্য। কিন্তু অনেকেই ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আগে একটা যুগপৎ ছিল। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, যুগপৎ আন্দোলনের খবর কী? কোনো খবর নাই। এখন যুগপৎ নাই।’
আবার যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘৭ জানুয়ারির পর মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, বিরোধীরা পারেনি। আমরা চেয়েছিলাম সরকারের পতন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তার অধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন। এগুলোর কিছুই হয়নি। তাই মানুষ এভাবে ভাবতেই পারে। আবার যুগপৎ আন্দোলন হতে পারে। এই দুঃশাসন কেউ এককভাবে সরাতে পারবেন না।’
২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট। এরপর টানা এক বছরেরও বেশি সময় নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে তারা। বিএনপির পাশাপাশি আন্দোলনের শরিক বিভিন্ন দল ও জোট নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েই এসব কর্মসূচি পালন করে।
বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে একাধিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়। এর মধ্যে পাঁচদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট অন্যতম। এর বাইরে অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), এবি পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের দুই অংশ রয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারির ভোটের পর কর্মসূচি না থাকায় যুগপৎ আন্দোলনে ছন্দপতন হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলন-কর্মসূচি তো প্রতিদিন থাকে না। গত মে মাসেও শরিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে, কর্মসূচি ঠিক করা হবে।
গত মে মাসে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেছে বিএনপি। তবে কর্মসূচির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন ভোট বর্জনকারী বিভিন্ন দল ও জোট যার যার মতো করে কর্মসূচি পালন করছে।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পরের ছয় মাসে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নেই, তবে দলগুলোর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া আছে। ভবিষ্যতের করণীয় বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সবাই একমত, নির্বাচন বর্জনকে ঘিরে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেটাকে ধরে রাখতে হবে।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক একাধিক দল ও জোটের দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দল ও জোটগুলোয় হতাশা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের পরে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারায় আন্দোলনের প্রধান দল বিএনপির প্রতি কিছুটা ক্ষোভও রয়েছে শরিকদের। নিজেদের পর্যালোচনায় বিগত আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও কৌশলগত দুর্বলতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
জাতীয় নির্বাচনের পর শরিকেরা বিএনপিকে নিজেদের মতো করে আন্দোলনের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছে। শরিকদের মতে, আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা ছিল। কৌশল নির্ধারণ ও দিকনির্দেশনারও অভাব ছিল। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর আন্দোলন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সমন্বয় ছিল না। পরবর্তী আন্দোলনে যেতে হলে দুর্বলতার জায়গাগুলো ঠিক করে এগোতে হবে।
এখন বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো যার যার মতো করে কর্মসূচি পালন করছে। বিভিন্ন ইস্যুতে কোনো দল কর্মসূচি দিলে সেখানে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক অন্যান্য দল ও জোটের নেতারাও উপস্থিত থাকছেন। যুগপৎ কর্মসূচি না থাকলেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও একে অন্যের কর্মসূচিতে গিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন নেতারা। যুগপৎ আন্দোলনের ঐক্য ধরে রাখতে সবাই আন্তরিক বলে নেতারা জানান।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ৭ জানুয়ারির পর যুগপৎ আন্দোলন আরেক পর্বে প্রবেশ করেছে। নতুন প্রেক্ষাপটে কীভাবে আন্দোলন দাঁড় করানো হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দলগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি পর্ব চলছে। আগামী দু–এক মাসের মধ্যেই আন্দোলনের অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে আসবে।