উপজেলা নির্বাচন

মন্ত্রী–এমপির স্বজনদের সরে দাঁড়াতে গড়িমসি

দলীয় নির্দেশনার পরও মন্ত্রী-এমপিদের প্রায় ২৫ স্বজন এখনো প্রার্থী। আজ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন।

দলের সিদ্ধান্ত মেনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, নিকটাত্মীয় ও স্বজনেরা উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে আজ সোমবার প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে দলের সিদ্ধান্ত মেনে সবার সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে। সূত্র বলছে, সাংগঠনিক সম্পাদক ও অন্যান্য সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে সারা দেশে এখন পর্যন্ত মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের নিকটাত্মীয় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে আছেন ২৫ জনের মতো। এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এর মধ্যে ১৫ জনের মতো আছেন প্রথম পর্বে। বাকিরা দ্বিতীয় বা অন্য পর্বে ভোট করবেন।

তবে নাটোরের সিংড়ায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিব গতকাল রোববার সরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। এর বাইরে আর কেউ গতকাল সরে দাঁড়াননি।

আওয়ামী লীগের চারজন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা ভোট করছেন এমন সংসদ সদস্যদের সবাইকে দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে একাধিকবার ফোন করে স্বজনদের বসিয়ে দিতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা গড়িমসি করছেন। নানা অজুহাত ও সমস্যার কথা তুলে ধরছেন। আজও তাঁরা ফোনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে সাংগঠনিক সম্পাদকেরা জানিয়েছেন।

একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করা ছাড়া তাঁদের হাতে কোনো বিকল্প নেই। ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক রয়েছে। ওই বৈঠকে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের তালিকা তুলে দেওয়া হবে। তখন হয়তো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

এবার চার পর্বে উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। প্রথম পর্বে ১৫০টি উপজেলায় ভোট হবে ৮ মে। দ্বিতীয় পর্বের ভোট হবে ১৬১টি উপজেলায় ২১ মে। এই পর্বের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা গতকাল শেষ হয়েছে।

পেছানোর পথ রাখেননি সংসদ সদস্যরা

নোয়াখালীর হাতিয়ায় নারী ও পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে গেছেন। বাকি আছে চেয়ারম্যান পদের ভোট। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী তাঁর ছেলে আশিক আলীকে প্রার্থী করেছেন। আওয়ামী লীগের আর কেউ প্রার্থী হওয়ার সাহস করেননি। ছেলের প্রার্থিতা কোনো কারণে বাতিল হয়ে গেলে চেয়ারম্যান পদ যাতে পরিবারের মধ্যেই থাকে, সে জন্য সংসদ সদস্য নিজের স্ত্রী দুবারের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌসকেও ‘ডামি’ প্রার্থী করেছেন। এখন সংসদ সদস্যের স্ত্রী ও ছেলে সরে গেলে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী থাকবেন না। এর আগে গত দুই মেয়াদে হাতিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন সংসদ সদস্যের ভাই মো. মাহবুব মোর্শেদ।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় পার্টির মুশফিকুর রহমান এখানে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। যদিও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো প্রার্থী নন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে লড়াই করে মাত্র ছয় হাজার ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। আর এবার তিনি উপজেলা ভোটে দাঁড়িয়েছেন।

সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী দাবি করেন, উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার নেতারা এবং বর্তমান চেয়ারম্যান তাঁর ভাই মাহবুব মোর্শেদ সম্মিলিতভাবে আশিক আলীর নাম প্রস্তাব করেছেন। এ জন্য আওয়ামী লীগের অন্য কেউ প্রার্থী হননি। আর স্ত্রীকে প্রার্থী করেছেন সতর্কতার জন্য, ‘ডামি’। এ অবস্থায় তাঁর ছেলে বা স্ত্রী বসে গেলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিতে যাবেন। এটা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ জানে। এ জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে না।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার পরিস্থিতি আরও জটিল। এই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া একমাত্র ব্যক্তি বর্তমান চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সালের (বিপ্লব) চাচা। ফলে তিনি এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে।

স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সংসদ সদস্য ও তাঁর চাচার মধ্যে কিছুটা মনোমালিন্য হয়। এর ফলে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য দূর হয়ে যায়। ফলে আফসার উদ্দিন আর প্রার্থী হওয়ার সাহস করেননি।

এ বিষয়ে সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চাচা তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে চাচা প্রার্থী হননি।

এদিকে তৃতীয় পর্বে ভোট হবে বরিশালের আগৈলঝাড়ায়। এরই মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ নিজের ছেলে আশিক আবদুল্লাহকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। এ জন্য স্থানীয় কেউ আর প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছেন না। তাঁরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মেনে আশিক আবদুল্লাহ ভোট না করলে তাঁরা প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেবেন।

এর বাইরে মাদারীপুর সদরে সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর খান, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন ও পাশের সোনাতলায় তাঁর ভাই মিনহাদুজ্জামান উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। গতকাল রাত পর্যন্ত তাঁরাও সরে যাননি।

আওয়ামী লীগের বিলম্বিত সিদ্ধান্ত

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তাদের মূল চিন্তা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে। কারণ, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে আরও সময় আছে। ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত মানাতে সময় পাওয়া যাবে। এ ছাড়া মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরাও দলের সিদ্ধান্ত জেনে যাওয়ার কারণে স্বজনদের প্রার্থী করার বিষয়ে উৎসাহ পাবেন না। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে ইতিমধ্যে প্রার্থীরা মাঠে আছেন। টাকাপয়সাও খরচ করে ফেলেছেন। কোথাও কোথাও স্থানীয় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা নিজেদের স্বজনদের প্রার্থী ঘোষণা করার কারণে অন্যরা আর প্রার্থী হওয়ার সাহস পাননি।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের সরে দাঁড়াতে নির্দেশনা দিয়েছে ১৮ এপ্রিল। আর প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ১৫ এপ্রিল। অর্থাৎ চাইলেও অনেকে আর মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এ জন্যই কোথাও কোথাও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনেরা একমাত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী কিংবা আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হয়ে গেছেন। তাঁদের বাদ দিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকে না কিংবা ভোটই হবে না। যেখানে দলের একাধিক প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়েছেন, সেসব উপজেলার প্রার্থীরা সুবিধা পাবেন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য ছিল বিএনপি-জামায়াতবিহীন উপজেলা নির্বাচন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের প্রভাবমুক্ত রাখা। এ ছাড়া তৃণমূলের যেসব নেতার সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ক্ষীণ, তাঁদের উপজেলা চেয়ারম্যান পদে সুযোগ দেওয়াও ছিল লক্ষ্য। কিন্তু মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা স্বজনদের বাইরেও বেশির ভাগ স্থানে নিজের লোককে ‘মাই ম্যান’ প্রার্থী করেছেন। প্রথমত, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের একটা বড় অংশ প্রার্থী থেকে যেতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সংসদ সদস্যের নিজের লোকেরাও থাকছেন। ফলে আওয়ামী লীগের লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে—এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতেও মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছিল। তিনি বলেন, দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে বলে তিনি আশাবাদী। কেউ সিদ্ধান্ত অমান্য করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।