বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট।
জোটের অভিযোগ, বাস্তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির ওপর নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ছাত্রলীগকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন জোটের নেতারা।
আজ শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের পক্ষ থেকে এই দাবি জানানো হয়। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে জোটের কেন্দ্রীয় কমিটি এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান প্রগতিশীল ছাত্রজোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সভাপতি আল কাদেরী জয়।
প্রগতিশীল ছাত্রজোটের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়েছে। এগুলো হলো:
আবরার ফাহাদসহ ক্যাম্পাসগুলোয় সব হত্যাকাণ্ডের বিচার ও রায় অবিলম্বে কার্যকর, আবাসিক হলগুলোয় টর্চার সেল ও গেস্টরুম নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা, প্রথম বর্ষ থেকেই প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে সব শিক্ষার্থীর হলের সিটের অধিকার নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিকভাবে বুয়েটসহ সব ক্যাম্পাসে সব ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি করার অধিকার এবং রাজনীতির নামে কেউ অপরাজনীতি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এটি একটি ভয়ংকর অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এবং সব ধরনের বিরোধী মত ও তার ভিত্তিতে সংগঠিত শক্তিকে দমনের হাতিয়ারমাত্র; এটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি প্রতারণাও বটে। আবরার ফাহাদ হত্যাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বুয়েটে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ছাত্রলীগের একচ্ছত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও দখলদারির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির প্রতি নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী বুয়েটে আগে থেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ আর গত এক দশকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতিই ছিল না। সেখানে রাজনীতির নামে ছিল ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর নির্যাতন। বিরোধী কোনো ছাত্রসংগঠন ওই ক্যাম্পাসে কাজ করতে গেলে নির্মমভাবে তাদের দমন করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নিহত আবরার ভারত-বাংলাদেশ সমঝোতা চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, যা একটি রাজনৈতিক বিষয়। এই চুক্তির বিরোধিতা করা নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। এই অধিকার যারা দমন করে, তারাই আবরারের হত্যার জন্য দায়ী। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা হত্যাকাণ্ডের দায় ছাত্ররাজনীতির ওপর চাপিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের অসন্তোষকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বেশ কিছু পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ। কিন্তু তাতে কি সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের দৌরাত্ম্য কমেছে? তাৎক্ষণিকভাবে চমকপ্রদ মনে হলেও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এর আগেও বিভিন্ন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন তকমা দিয়ে মারধর করা হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে বুয়েট প্রশাসন কখনোই ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের এই নির্লিপ্ততা প্রকারান্তরে পৃষ্ঠপোষকতারই নামান্তর। এখানে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এই ঘটনার মূল উৎস যে অগণতান্ত্রিক চর্চা, সেই চর্চাকেই আড়ালে আরও শক্তিশালী করার আয়োজন করেছে বুয়েট প্রশাসন। ইতিমধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৫৮টি টর্চার সেলের কথা পত্রিকায় এসেছে। এই টর্চার সেলগুলোয় অকথ্য ভাষায় গালাগালি এবং শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চলে। এর মাধ্যমে তারা একদল মৃত মানুষ তৈরি করতে চায়, একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখে, যাতে কেউ প্রতিবাদ না করতে পারে। শিক্ষার্থীদের এই ভয়ই ক্ষমতাসীনদের শক্তি ও লুটপাটের রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে।
জোটের অন্যতম নেতা নাসির উদ্দীন প্রিন্স বলেন, ছাত্রলীগের রাজনীতি কোনো রাজনীতি নয়, বরং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। গত ১০ বছরে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কেউ ছিল না। তাদের নির্যাতন ও দখলদারিই শিক্ষার্থীদের সামনে রাজনীতি হিসেবে দৃশ্যমান ছিল। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ক্যাম্পাসগুলো থেকে যদি ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে, একই কর্মকাণ্ডের দায়ে ছাত্রলীগকেও নিষিদ্ধ করা উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ রানা, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় সভাপতি ইকবাল কবীর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।