চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় গোলাগুলিতে লিপ্ত আটজনের মধ্যে ছয়জনের পরিচয় শনাক্ত। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গোলাগুলিতে লিপ্ত দুই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর অস্ত্রধারী আট অনুসারীর মধ্যে ছয়জনকে শনাক্ত করা গেছে। তাঁদের মধ্যে চারজনই নৌকার প্রার্থী মো. আকতার হোসেনের অনুসারী। অপর দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিনের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিলেন।
গত সোমবার ইউপি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চলাকালে দুই প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সকাল সাড়ে নয়টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা গোলাগুলি চলে। খাগরিয়া গনিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র ও ৭ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রকে ঘিরে দুই পক্ষের মধ্যে এই গোলাগুলি হয়। এ ঘটনায় কেন্দ্র দুটিতে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এ সময় গনিপাড়া কেন্দ্র থেকে ব্যালটও ছিনতাই হয়। গোলাগুলিতে লিপ্ত দুই পক্ষের আটজন অস্ত্রধারীর ছবি গতকাল প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় খাগরিয়ায় ফল ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে।
তবে অস্ত্রধারীদের কেউ গতকাল রাত সাড়ে নয়টায় এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। তবে পুলিশের অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক।
ইউপি নির্বাচনের আগে গত বৃহস্পতিবার আকতার হোসেন প্রকাশ্যে সভায় তাঁর দুটি অস্ত্র সব সময় গুলি ভর্তি থাকে বলে প্রতিপক্ষকে হুমকি দেন। হুমকির এই ভিডিওটি ভাইরাল হলে পুলিশ পরদিন তাঁর লাইসেন্স করা অস্ত্র দুটি জমা নেয়।
সোমবার সাতকানিয়ার ১৬ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় খাগরিয়াসহ অন্তত ছয়টি ইউনিয়নে বড় ধরনের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। নলুয়ায় সহিংসতায় স্কুলছাত্র মো. তাসিব ও বাজালিয়া ইউনিয়নে আবদুস শুক্কুর নামের একজন নিহত হন। শুক্কুর স্থানীয় লোক নন বলে এলাকাবাসী জানান।
ছয়জনের পরিচয় শনাক্ত
খাগরিয়ায় আট অস্ত্রধারীর মধ্যে পরিচয় শনাক্ত হওয়া ছয়জন হলেন মো. নাছির উদ্দিন, মো. কামরুল আলম আজাদ ওরফে সুমন, মো. শাখাওয়াত, মো. এজাহার. মো. কায়েস ও মো. আবছার। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, শেষ দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিম উদ্দিনের অনুসারী। বাকিরা আকতার হোসেনের।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলোর ভাষ্য, শনাক্ত হওয়া অস্ত্রধারীদের সেভাবে কোনো রাজনৈতিক পদ নেই। তবে তাঁরা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মী। বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আকতার হোসেনের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় তাঁরা থাকেন। দলীয় কর্মীর পাশাপাশি নিজের অফিসের কর্মচারীদের দিয়ে অস্ত্রবাজি করিয়েছেন আকতার হোসেন।
অস্ত্রধারীদের মধ্যে বর্তমান চেয়ারম্যান আকতার হোসেনের অফিসের কর্মচারী মো. নাছির উদ্দিন রয়েছেন। গলায় মেরুন রঙের মাফলার ও মুখে লাল-সবুজ রঙের মাস্ক পরিহিত ছিলেন তিনি। গলায় আকতার হোসেনের ছবি ও প্রতীকসংবলিত ব্যাজ ঝুলছিল। তাঁর হাতে ছিল একনলা বন্দুক।
মো. নাছির উদ্দিনের বাবার নাম জামাল উদ্দিন। তাঁর বাড়ি খাগরিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিশানা বাপের বাড়ি। চেয়ারম্যান আকতার হোসেনের মালিকানাধীন পাইওনিয়ার ট্রেডিং করপোরেশন নামে সিঅ্যান্ডএফ অফিসে ‘কাস্টমস সরকার’ পদে কর্মরত রয়েছেন নাছির উদ্দিন। চট্টগ্রাম কাস্টমস শাখার এক কর্মকর্তা অস্ত্রসহ ছবি দেখে নাছিরকে শনাক্ত করেছেন।
জানতে চাইলে আকতার হোসেন বলেন, ‘নাছিরের বাড়ি জসিমের এলাকায়। আমার স্টাফ নাছির অস্ত্র হাতে ছিল না। এটা মিথ্যা কথা। জসিম বহিরাগতদের এনে অস্ত্রবাজি করে কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করেছে। এ ছাড়া তার ভাইয়েরাও অস্ত্র নিয়ে কেন্দ্র দখল করেছে। আমার লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে ধাওয়া করেছে। আমাদের অস্ত্র ছিল না।’
প্রথম আলোয় গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রধান ছবিতে দুজন অস্ত্রধারীর ছবি দেখা যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে কালো ও লাল হেলমেট পরিহিত প্রথমজনের নাম মো. কামরুল আলম আজাদ ওরফে সুমন। তাঁর গলায় একটি ব্যাগ রয়েছে। হাতে একনলা বন্দুক। তাঁর ফেসবুক আইডির নাম ইংরেজিতে লেখা রয়েছে মো. কে এ সুমন। সেখানে নিজেকে তিনি উত্তর সাতকানিয়া আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা বলে পরিচয় দেন। কামরুল আলম সব সময় আকতার হোসেনের সঙ্গে থাকেন। কামরুলের বাড়ি সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নে। তবে এখন তাঁরা খাগরিয়ার বাসিন্দা। বাবার নাম কোরবান আলী। সপ্তাহখানেক আগে খাগরিয়ায় আরেকটি সংঘর্ষের মামলার আসামি কামরুল আলম।
কামরুল আলমের পেছনে যাঁকে অস্ত্র হাতে দেখা যাচ্ছে, তাঁর নাম মো. শাখাওয়াত। তিনি নতুন চরখাগরিয়া গ্রামের মফজল আহমেদের ছেলে। শাখাওয়াত গত বছর ফেব্রুয়ারিতে চন্দনাইশ পৌর নির্বাচনেও গোলাগুলিতে অংশ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। সেবার গুলিতে হাবিবুল ইসলাম নামের এক কলেজছাত্র মারা যায়। শাখাওয়াত ওই মামলার আসামি বলে স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। তিনি ভাড়ায় সহিংসতায় লিপ্ত হন বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
প্রথম আলোর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আরেকটি ছবিতে দেখা যায় কালো হেলমেট পরিহিত একজন বাঁ হাতে একটি বন্দুক নিয়ে ছুটছেন। তাঁর নাম মো. এজাহার। বাবার নাম তমিজ উদ্দিন। তাঁর বাড়ি চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী এলাকায়। এটা খাগরিয়ার পাশের এলাকা।
আরেকটি ছবিতে দেখা যায় পুকুরপাড় দিয়ে অস্ত্র হাতে হেঁটে যাচ্ছেন একজন। তাঁর নাম কায়েস। বাবা জাকির হোসেন। তিনি চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম উদ্দিনের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিলেন বলে জানা গেছে।
প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত ছবিতে মাথায় পাগড়ি পরিহিত একজনকে অস্ত্র হাতে বিলের মধ্যে ছুটতে দেখা যাচ্ছে। তাঁর নাম মো. আবছার। বাড়ি আমিরখীল এলাকায়। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিমের হয়ে অস্ত্র হাতে নেন বলে জানা গেছে।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, জসিম উদ্দিনের পক্ষে অস্ত্রধারীদের অনেকেই ছিল বহিরাগত। এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। জসিম উদ্দিন একসময় এলডিপির রাজনীতি করতেন। এখন তিনি কোনো দল করেন না বলে একাধিক সূত্রের ভাষ্য।
অস্ত্রধারীরা গ্রেপ্তার হয়নি
গোলাগুলির ঘটনার পর সোমবার ও গতকাল সাতকানিয়ার খাগরিয়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গতকাল সন্ধ্যায় খাগরিয়া থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় একটি এলজি উদ্ধার করা হয়। তবে তাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিহ্নিত অস্ত্রধারীরা নেই বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, খাগরিয়া থেকে গতকাল চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি এলজি উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযান এখনো চলছে।
অস্ত্রধারীদের চিহ্নিত করার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, সব অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করা হবে। সব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যুবলীগের নেতা পার্থ সারথীর ওপর হামলার ঘটনায়ও সাতকানিয়া থানায় মামলা হয়েছে।
নির্বাচনের আগের দিন রোববার রাতে খাগরিয়ায় গিয়ে মারধরের শিকার হন দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী চৌধুরী ও তাঁর তিন সহযোগী। এ ঘটনার জন্য জসিম উদ্দিনকে দায়ী করা হয়।
ইউপি নির্বাচনে অস্ত্রবাজি প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাক্সে ভোট আনার জন্য প্রার্থীরা কী করছেন, তা সবাই দেখছেন। ব্যাপারটা এ রকম যে চেয়ারে বসতে হলে অস্ত্র চালাতে জানতে হবে। শুধু চেয়ারম্যান নয়, মেম্বারগিরি করতে গিয়েও মানুষ মারা হচ্ছে। অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় আনা খুব জরুরি। নইলে সামনের নির্বাচনগুলোতে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়বে।’