ওয়ারীর দক্ষিণ মুহসেন্দী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নারী ভোটকেন্দ্রে (৪ নম্বর) ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছেন মাত্র ১ ভোট। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ১ হাজার ৯১১ জন। ভোট দিয়েছেন ৩৪৯ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস একাই পেয়েছেন ৩৪৬ ভোট। বাকি দুই ভোটের একটি পেয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা), আরেকটি পেয়েছে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (আম)।
১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ১৯টি কেন্দ্রে ১০ ভোটের কম পেয়েছেন। ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর এত কম ভোট পাওয়াকে বিস্ময়কর বলে মনে করছেন অনেকে। দক্ষিণ সিটিতে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালামের দাবি, ‘ভোট হলো কই। তারা (নির্বাচন কমিশন) মনমতো কিছু ভোটার সংখ্যা বসিয়ে দিয়েছে।’
ইশরাক ১০ ভোটের কম পেয়েছেন এমন আরেকটি কেন্দ্র হচ্ছে গণকটুলীর হরিজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নারী ভোটকেন্দ্রে। এখানে ভোটার ২ হাজার ১১৫ জন। এই কেন্দ্রে ইশরাক পেয়েছেন মাত্র ৮ ভোট। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তাঁর চেয়ে ১৪২ গুণ বেশি ভোট পেয়েছেন। তাঁর ভোট ১ হাজার ১৩৬টি। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১ হাজার ১৫৬টি। বাকি ১২টি ভোট পেয়েছেন অপর চার প্রার্থী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ভোটের হার মাত্র ২৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৯ শতাংশ। দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডে এবার ভোটার ছিল ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ জন। মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন সাতজন। তাঁদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আবদুর রহমান। তিনি পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫২৫ ভোট, যা মোট ভোটারের ১ শতাংশ।
>১ হাজার ১৫০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১৪৬টিতে নৌকার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে ধানের শীষ।
দক্ষিণে ১ হাজার ১৫০টি ভোটকেন্দ্রের মেয়র পদের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, কামরাঙ্গীরচরের লিলি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নারী ভোটকেন্দ্রে ৫ শতাংশও ভোট পড়েনি। এই কেন্দ্রের ১ হাজার ৬৭২ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৬৯ জন। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে ভোট পড়েছে ৬২টি। আর ধানের শীষে ৩টি। কামরাঙ্গীরচরের জননী কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৯০ জন। ভোটার ছিলেন ১ হাজার ৬৮৩ জন। ৯০ ভোটের ৮২ ভোটই পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। ধানের শীষে পড়েছে চারটি, হাতপাখার তিনটি এবং লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন একটি ভোট। শতকরা হিসাবে কেন্দ্রটিতে ভোট পড়েছে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, যে দুটি ভোটকেন্দ্রে খুব কম ভোট পড়েছে, তা ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। সেখানে কাউন্সিলর পদে দলে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। নির্বাচনে প্রচারের সময় দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকদের একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছিল। এ অবস্থায় ভোটের দিন সংঘর্ষ হয় কি না, তা নিয়ে হয়তো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল। যে কারণে লোকজন ভোটকেন্দ্রে কম গেছেন।
ঢাকা দক্ষিণে ৬ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে ৬টি কেন্দ্রে। ২৫টি কেন্দ্রে ১০ শতাংশও ভোট পড়েনি। ১০৭টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১৫ শতাংশের নিচে। ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৪৬টি কেন্দ্রে। ১৪টি কেন্দ্রে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। আর ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৫টি কেন্দ্রে। এই সিটিতে মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে নগরপিতার চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। পরাজিত বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন পেয়েছেন মোট ভোটারের ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ ভোট।
নির্বাচনের দিন প্রায় সব কেন্দ্রের সামনেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দিনভর অবস্থান করতে দেখা গেছে। এমনই একটি ভোটকেন্দ্র হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি। ১ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন দুপুরের দিকে কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, ভোটকেন্দ্রের ভেতরের মাঠে এবং কেন্দ্রের আশপাশে কয়েক শ লোক অবস্থান করছেন। তাঁদের সবার বুকেই নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগানো ছিল। ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ১৬৬টি। অথচ ভোটার ছিলেন ১ হাজার ৭০৯ জন। ভোটের হার ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
কেন্দ্রের সামনে শতাধিক নেতা–কর্মীর উপস্থিতি থাকলেও কম ভোট পড়ার কারণ জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রের সামনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বহিরাগত হতে পারেন। তাঁরা হয়তো মহড়া দিয়ে ভোটারদের বাধাগ্রস্ত করতেই কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। বহিরাগতদের অবস্থানের কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে আগ্রহ দেখাননি। তাই ভোটও কম পড়েছে।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজে নারী ভোটারদের একটি কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৮৭ জন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ১ হাজার ১১৩ জন। ভোটের হার ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। একই প্রতিষ্ঠানে পুরুষ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ১১০টি। এখানে ভোটার ছিলেন ২ হাজার ৯ জন। ভোটের হার ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
ঢাকা দক্ষিণের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট ১ হাজার ১৫০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৭ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে ৯টি কেন্দ্রে, ৮ শতাংশের নিচে পড়েছে ১৫টিতে, ৯ শতাংশের নিচে পড়েছে ১৮টিতে, ১০ শতাংশের নিচে পড়েছে ২৫টিতে, ১১ শতাংশের নিচে ৩৪টিতে, ১২ শতাংশের নিচে ৪১টিতে, ১৩ শতাংশের নিচে ৫৯টিতে এবং ১৪ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে ৮০টি কেন্দ্রে।
৪৬ কেন্দ্রে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট
১ হাজার ১৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে মাত্র ৪৬টি কেন্দ্রে। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে খিলগাঁওয়ের সেরকান্দি এলাকার দাসেরকান্দি হাজেরা বেগম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে ভোটার ১ হাজার ৫৬৮। ভোট দিয়েছেন ১ হাজার ২১৪ জন। ভোটের হার ৭৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কেন্দ্রটিতে নৌকা প্রতীকে ভোট পড়েছে ৭৯৪টি। ধানের শীষ প্রতীকে পড়েছে ৩৯৮টি।
একই এলাকার ফকিরখালী নূরানীয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৭৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৯৬৪ জন। ভোট দিয়েছেন ৭৪৪ জন। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছেন ৪৮৩ জন এবং ধানের শীষে ১৯৬ জন। এক কেন্দ্রে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩১টি ভোট পড়েছে আম প্রতীকে।
১৪৬ কেন্দ্রে জয়ী ইশরাক
মোট ১৪৬ ভোটকেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন। আর তিনটি কেন্দ্রে নৌকা ও ধানের শীষের ভোট ছিল সমান। এই তিন কেন্দ্র হচ্ছে দনিয়ার এ কে হাইস্কুল (দুই প্রার্থী ৪০৭ ভোট করে), জুরাইন আদর্শ একাডেমি (১৮০ ভোট করে) ও যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল হাইস্কুল ভোটকেন্দ্র (২৪৯ ভোট করে)। ইশরাকের নিজ ভোটকেন্দ্র গোপীবাগের শহীদ শাহজাহান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটার ছিল ১ হাজার ৬০২ জন। ভোট দিয়েছেন ৫৩৫ জন। এর মধ্যে ধানের শীষ পেয়েছে ২৯৬ ভোট। আর নৌকা প্রতীকে ভোট পড়েছে ২১৬টি।