২০১৮ সালে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হামলা করে প্রথম আলোচনায় আসে হেলমেট বাহিনী।
চেহারা আড়াল করতে হেলমেট পরে সহিংসতা বা হামলার ঘটনায় অংশ নেওয়ার ঘটনা এখন নতুন প্রবণতা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের হামলাকারীরা ‘হেলমেট বাহিনী’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। চার বছর আগে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে প্রথম আলোচনায় আসে হেলমেট বাহিনী। সর্বশেষ গত সপ্তাহে নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনায় আবার আলোচনায় আসে হেলমেটধারী দুর্বৃত্তরা। ২০১৮ সালের মতো এবারও হেলমেটধারী হামলাকারীদের মধ্যে যাঁরা শনাক্ত হয়েছেন, তাঁরা সবাই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন সময় হামলা-সংঘাতে ‘হেলমেট বাহিনী’ আলোচনায় এলেও তাঁদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার নজির নেই। এ ধরনের ঘটনায় প্রতিবারই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতার কথা আলোচনায় এলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ আগে কখনো এ বিষয়ে কোনো তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি। ছাত্রলীগকেও সাংগঠনিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে ‘হেলমেট বাহিনী’ দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
৪ ও ৫ আগস্টের হামলায় অংশ নেওয়া ওই হেলমেটধারী যুবকেরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। গণমাধ্যমে তখন তাঁদের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘হেলমেট বাহিনী’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ওই ঘটনায়ও ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম আসে।
তবে এবার নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনার পর ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে নিউমার্কেট এলাকার সংঘর্ষের সময় কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনায়ও হেলমেটধারীদের দেখা গেছে। ভিডিও ফুটেজ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে এখন পর্যন্ত যাঁদের শনাক্ত করা গেছে, তাঁরা ঢাকা কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। একই দিন দোকানকর্মী মোরসালিন হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যেও হেলমেটধারী তরুণেরা ছিলেন বলে প্রাথমিক তদন্তে এসেছে।
গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় হেলমেট পরে সহিংসতা ও হত্যার ঘটনায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা সন্ত্রাসী। তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।
২০১৮ সালের ৮ এপ্রিলের রাতটি ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্ত। ৮ এপ্রিল মধ্যরাতে একদল সশস্ত্র যুবক হেলমেট পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মহড়া দেন। তাঁদের কয়েকজন হেলমেট পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন হামলা-ভাঙচুরেও অংশ নেন। পরে জানা গেছে, ওই হেলমেটধারী সশস্ত্র যুবকেরা ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলেন।
ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম ও আবদুল করিম বাসচাপায় নিহত হলে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। ৪ আগস্ট আন্দোলনের সপ্তম দিনে রাজধানীর জিগাতলা, ধানমন্ডি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর হামলা হয়। হামলাকারীরা ছিলেন পুলিশের সঙ্গে। তাঁদের মাথায় ছিল হেলমেট এবং হাতে রড, লাঠিসোঁটা, রামদা ও চাপাতি। একাধিক যুবকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে।
পরদিন ৫ আগস্ট আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আবার হামলা হয়। এদিন সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় হেলমেটধারীরা হামলা চালান। তাঁরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করেন। পুলিশের সামনেই হামলাকারীরা পুরো এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দেন। পরে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা এবং গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ৪ ও ৫ আগস্টের হামলায় অংশ নেওয়া ওই হেলমেটধারী যুবকেরা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। গণমাধ্যমে তখন তাঁদের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘হেলমেট বাহিনী’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ওই ঘটনায়ও ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম আসে।
এ ধরনের ঘটনায় বারবার ঢাকা কলেজের ছাত্রদের নাম এলেও তাঁদের চিহ্নিত করে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, আগের ঘটনাগুলোর সময় তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন না। তাই সেগুলোর বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। তবে নিউমার্কেট এলাকায় সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সম্পৃক্ততা ছিল কি না, তা খুঁজতে গত সোমবার তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বারবার ‘হেলমেট বাহিনী’ হিসেবে ছাত্রলীগের নাম আসছে। সংগঠনের পক্ষ থেকেও এই হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তাঁদের নিবৃত্ত করতে বা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মুঠোফোনে গতকাল বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
পরে এ বিষয়ে প্রথম আলোর কথা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, হেলমেট বাহিনী বা সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই৷ সৈয়দ আরিফ হোসেনের মতে, ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে যাঁরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। ফলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।
হেলমেট পরে বিভিন্ন সময় হামলা বা সংঘর্ষে অংশ নিয়েছেন, ঢাকা কলেজের এমন অন্তত তিনজন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজনই দাবি করেন, ‘হেলমেট বাহিনী’ বলতে আসলে কিছু নেই। এসব ‘অপপ্রচার’। তাঁদের ভাষ্য, তাঁরা মাথার সুরক্ষার জন্য মারামারির সময় হেলমেট ব্যবহার করেন। কারও কারও ক্ষেত্রে পরিচয় গোপন করার বিষয়টিও আছে।
ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ‘বিলুপ্ত কমিটির’ যুগ্ম আহ্বায়ক ফুয়াদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সংঘর্ষ-সংঘাতের মধ্যে দুই পক্ষের ইটপাটকেল ছোড়াছুড়িসহ আকস্মিক আঘাত থেকে নিজেদের মাথার সুরক্ষার জন্যই ছাত্ররা হেলমেট ব্যবহার করে থাকেন। এখানে পরিচয় লুকানোর কোনো বিষয় নেই।
তবে পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহেন শাহ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এখানে কোনো সংগঠিত হেলমেট বাহিনী আছে, বিষয়টি এমন নয়। দুষ্কৃতকারীরা নিজের মাথার সুরক্ষা ও পরিচয় লুকানোর জন্যই হেলমেট ব্যবহার করে থাকে।