ভোটের শেষ দিকে এসে বিতর্ক–উত্তাপ ছড়িয়েছে ইসির চিঠির পরও স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের এলাকা না ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি। আইনগত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ইসি। আগামীকাল বুধবার কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে। ভোটের আগে প্রথম আলো কথা বলেছে মেয়র প্রার্থী মনিরুল হকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেলিম জাহিদ ও গাজীউল হক।
(কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন মনিরুল হক। যেভাবে তিনি কথা বলেছেন, সেভাবেই তুলে ধরা হয়েছে)
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাতে নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করেও পারেনি। এখান থেকে কী ইঙ্গিত পাচ্ছেন?
মনিরুল হক: প্রার্থী হিসেবে যেটা দেখছি, সেটা লিখিত অভিযোগে দিছি। সংসদ সদস্য ওনার নির্বাচনী এলাকায় কোনো প্রচার-প্রচারণা করতে পারত না, এটা জাইনাই আমরা লিখিত অভিযোগ দিছি। ওনারা (নির্বাচন কমিশন) তদন্ত করে সত্যতা পাওনের পর ওনারে (কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন) চিঠি দিছে। চিঠি পাওনের পরও কার্যকরী হচ্ছে না, উনি এলাকায় থাকতাছেন।
এর ইঙ্গিত কী?
মনিরুল হক: ইঙ্গিত হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। উনি (প্রধান নির্বাচন কমিশনার) যেটা পারত না, হেইডার লাইগা চিঠি দেয় কেন? প্রধান নির্বাচন কমিশনার ডাইরেক্ট বলছেন, একজন সংসদ সদস্যকে এলাকা থেকে বাইর করা ওনাদের কাজ না। তাহলে দায়িত্বটা কার? আমি তো আইন এত জানি না। আইনে যদি না থাকে, তাইলে এমপি সাব থাকব।
আপনি বলছেন, নিবাচন কমিশন ব্যর্থ। ব্যর্থ হলে নির্বাচনে কী প্রভাব পড়বে?
মনিরুল হক: ব্যর্থ মানে নির্বাচন কমিশন তো প্রথমেই হোঁচট খাইল। আমার কথা হইল মাননীয় এমপি সাবকে কেন চিঠি দেওয়া হইছে, একটা কারণেই তো দেওয়া হইছে। আর এখতিয়ার আছে বলেই তো দিয়েছে। আমি সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলাম। আমি যে কাজগুলো করেছি, যেগুলো প্রয়োগ করতাছি, সেগুলো যদি না হয় তাইলে আমি ব্যর্থ না? উনি নতুন সিইসি, উনি তো প্রথমেই ধাক্কা খাইল যে, উনি পারবে না।
এই ধাক্কার প্রভাব কি আপনার ভোটারদের মধ্যে হতাশা ছড়াবে?
মনিরুল হক: হতাশ হওনের কথা সিইসির। আমাদের হতাশার কী? এইটা (সংসদ সদস্যকে ইঙ্গিত করে) থাকলেও কী হইব, না থাকলেও কী হইব। আমার অহন ইলেকশন রান করতে অইব। কিন্তু আইন তো আমাদের সকলের জন্য সমান। আপনারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কওন, তো লেভেল ফিল্ড হইল কোন থেইকা?
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রসঙ্গ তুলছেন। আপনি তো ইতিমধ্যেই অভিযোগ করেছিলেন যে আপনার লোকদের বিভিন্নভাবে হুমকি–ধমকি দেওয়া হচ্ছে।
মনিরুল হক: এটা তো বাস্তব।
ভোটের দিনও কি এ রকম কিছু আশঙ্কা করেন?
মনিরুল হক: অগ্রিম তো বলতে পারতাম না, কিন্তু সিচুয়েশন তো এ রকমই যাইতাছে মনে হয়। এমপি সাবের (বাহাউদ্দিন) লোকজন তো ভালো না। সেলিম খান (১৪ নম্বর ওয়ার্ড) তিনবারের কাউন্সিলর। তাঁকে হ্যারেছমেন্ট করা হইছে, মারছে, তাঁর ছেলেকেও মারছে। আবার ২২ নম্বরের কাউন্সিলর শাহ আলম মজুমদার, তাঁকেও মারছে। এগুলো কী ইঙ্গিত করে? প্রার্থীকে মারতাছে, মারার পরে পুলিশ যাইয়া কিছুই বলে না তারারে। যারার নামে অভিযোগ করতাছে, পুলিশ যাইয়া কিছু অ্যাকশনে তো যাইব, তাইলে না এলাকার জনগণ বা ভোটারের আশ্বস্ত হবে। ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু ঘটনা প্রতিরোধের জন্য তো চেষ্টা করতে অইব। পুলিশ গেছে, কিন্তু কাউরে কিছু কয় না।
এমনই যদি চলতে থাকে, তাহলে ভোটে কী হবে?
মনিরুল হক: আমাদের ইলেকশন করতে হইব। কারণ, মাঠে যখন নামছি, ইলেকশন করতে তো হইবই।
তার মানে যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত থাকছেন?
মনিরুল হক: শেষ পর্যন্ত তো আমার দেখতে হইবই। কারণ, আমি আমার জনগণের জন্য ইলেকশন করতাছি। জনগণের আশা পূরণ করার লাইগা ইলেকশন, আমার আশা পূরণের লাইগ্যা না।
নির্বাচন কমিশনও যেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে টলাতে পারলেন না, মেয়র নির্বাচিত হলে তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া কীভাবে হবে?
মনিরুল হক: এটা তো আইনগত বিষয়। শুনেন, আমি সাক্কু দুইবার মেয়র, একবার চেয়ারম্যান ছিলাম, ৪২ বছর রাজনীতি করি। যারা রাজনীতি করে তাদের কইলজা বড় থাকে। উনিও রাজনীতিবিদ, আমিও রাজনীতিবদি। রাজনীতি–রাজনীতিতে মাইর অইব। আমি যদি অন্যায় করি, তাহলে সরকার দেখব। উনি আমাকে জেলে দেওয়ার কে? বড়জোর উনি সরকারকে বলতে পারবেন।
কিন্তু এত বছর সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের সঙ্গে মিলেই সিটি করপোরেশন চালিয়েছেন।
মনিরুল হক: হ্যাঁ, সবই করছি, এখনো তো করি। এখন আওয়ামী লীগ সরকার। একটা অনুদান বলেন, কিছু ফান্ড আনতে অইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বলা হইছে লোকাল এমপির লগে তোমরা কাজ করো। এটা আইনেই আছে। উনিও তো উন্নয়ন চায়, আমিও চাই। উন্নয়নের স্বার্থেই দুজন একখানে হইছি। এটাই নিয়ম। চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন খান সাব মেয়র ছিলেন বিএনপির সময়। উনি কি উন্নয়নের স্বার্থে বিএনপি সরকারের লগে সমঝোতা করে নাই?
হ্যাঁ, আপনি এইটা প্রশ্ন করতে পারেন, সামনে কী হইব। যেখানে গরু নাই, সেখানে ঘোড়া দিয়েও হালচাষ হয়। আমি আমার মতো চলুম। যত দিন টিক্ক্যা থাকতে পারি চইল্লুম। আমি ইলেকশনে দাঁড়াইছি, উনি (সংসদ সদস্য) ওনার প্রার্থী দিছেন—ভালো কথা। উনি আমার থেইক্যা বেটার হইলে পাস করব, না অইলে আমি পাস করুম। ব্যক্তিই না চেঞ্জ হইব, আমি হমু না অইলে উনি হইব। এর লাইগ্যা তো আমি সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছিলাম না কোনো সময়ে। কিন্তু ওনারা যেভাবে তিক্তভাবে কথা বলেন—এটা রামরাজত্বের দেশ না। আমরা রাজনীতি করে এই জায়গায় আসছি। জেল-জরিমানা, এগুলো সব দেইখ্যা আছি।
নির্বাচনে যদি পরাজিত হন, সরকারের দিক থেকে হয়রানি-নিপীড়নের আশঙ্কা করছেন?
মনিরুল হক: সরকারি নিপীড়ন—এইডা তো কোনো ব্যাপারই না। আমাকে যদি সরকার পাস না করায়, এইডাও কোনো ব্যাপার না। ইভিএম পদ্ধতি তারার কাছে, জনবল তারার কাছে, প্রশাসন তারার কাছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার কুমিল্লার ব্যাপারে... এখানে পরিবর্তন হোক বা না হোক—ওনার কিছু হইত না। আমি দুইবার যে মেয়র ছিলাম, ওনার কি ক্ষতি হইছে? আমি ওনারে মূল্যায়ন করছি, মূল্যায়ন করার কারণে আমি দলের ভিতরে বিরাগভাজন হয়ে গেছি।
মাঠে বেশ আলোচনা যে এ নির্বাচনে আপনি কুমিল্লা শহরের প্রতিষ্ঠিত প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
মনিরুল হক: হ্যাঁ, এইডাই বলি। আমি যদি অহন ইলেকশন না করতাম, বাহার ভাইয়ের (সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন) কাছে আমার মতো ভালো লোক আর থাকত না—এইটা বাস্তব সত্য। আমি যদি এবার ইলেকশন না করতাম, উনিই মানুষকে বলত, সাক্কুর (মনিরুল হকের ডাকনাম) মতো ভালো ছেলে নাই। আমি তো একটা পার্টি করি। তিন মাস ধইরা সার্ভে করছি, যারার লগে এই দুইটা টার্ম চলাফেরা করছি, মানুষের সুখ-দুঃখ শুনছি, তারা আমার সুখ-দুঃখ শুনছে। বুঝলাম আমি তাঁদের আস্থার স্থল। এক দিকে আছে বাহার ভাই, আরেক দিকে আমাকে ফেল করানোর লাইগা আমার পার্টি থেকে আমার বিরুদ্ধে লোক দাঁড়া করাইছে। দুইজনকে আমি ফেস (মোকাবিলা) করছি।
আপনার দলের প্রার্থীকে কারা নামিয়েছে? নির্বাচনে এর কী প্রভাব দেখছেন?
মনিরুল হক: আমি তো দুইবারের মেয়র, এবারও ইলেকশনে দাঁড়াইছি। সবকিছুর একটা সিম্পটম (উপসর্গ) আছে। জ্বর হইলেও আগে কিন্তু গা-হাতে ব্যথা করে, এর পরেই না জ্বর ওঠে। হের তো (মোহাম্মদ নিজামউদ্দিনকে ইঙ্গিত করে) সিম্পটম দেখলাম না ইলেকশন করনের। একজন নামছিল দুই মাস আগে। একটু ঘুইরা-টুইরা বুইজজ্যা চইলা গেছে। আর অহনকা উনি সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াছিন (আমিন উর রশীদ ইয়াছিন) সাবের শালা (শ্যালক)। কেউরে পাইছে না, অহন শালারে নামাইছে আমার কিছু ভোট নষ্ট করনের লাইগা। কয়টা কর্মী থাকা আর নির্বাচন এক জিনিস না।
আপনি নিজেই বলেছেন, শহরের উন্নয়নে অনেক কিছইু করতে পারেননি। তাহলে কী করে আশা করেন, ভোটে জনগণ আপনাকে সমর্থন দেবেন।
মনিরুল হক: একটা লোক সবকিছু পারে না। এখানে সময়ের ব্যাপার আছে। আমরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনার মতো পুরোনো সিটি করপোরেশন না, আমরা নতুন। দুইটা পৌরসভাকে একখানে কইরা আমাকে নগরপিতার মতো বানাইছে। নগরপিতার কাজ কী, এইডাই তো আমি জানছি না। হইয়া গেছি, মানুষ বানাইছে। চেষ্টা করছি, অনেক কিছু করেছি, আবার অনেক কিছু করতে পারি নাই। যেটা পারি নাই, সেইটা করার লাইগাই দাঁড়াইছি।
নির্বাচনী ইশতেহারে দুই হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের উল্লেখ আছে। সমালোচকেরা বলছেন, মোটা অঙ্কের প্রকল্পগুলোর দিকেই লোভ জনপ্রতিনিধিদের, বিশেষ করে পারসেন্টেজের (ভাগাভাগি) দিকে।
মনিরুল হক: শুনেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের বাইরে না। ১০ পারসেন্ট কওন, ট্যাকা খাওন—সবখানে আছে। টেন্ডার হয় অনলাইনে, অহন কে কাজ পাইব, এইডা কি মেয়র জানব? মন্ত্রী জানব?
এর আগে প্রথম আলোকে বলছিলেন, নির্বাচিত হলে আপনি আপনার মতো চলবেন, না পারলে ছেড়ে দেবেন।
মনিরুল হক: আমি এখনো একই কথাই বলি। আমি শক্ত আছি, আমি মাথা নত কইরা চলইন্ন্যা না। আমি জীবনে বহু কিছু পাইছি, পার্টি থেকেও পাইছি, ব্যক্তিগতভাবেও পাইছি। জন্মের পর বাসায় গাড়ি পাইছি। দুইবার মেয়র ছিলাম, শান্তিপূর্ণভাবে বুঝায়ে দিয়া আসছি, এর থেকে বড় পাওনা তো আর কিছু নাই। সুতরাং আমার ডরের কী আছে।
২০১৭ সালে আপনার নির্বাচনী ইশতেহারের প্রচ্ছদে স্লোগান ছিল ‘ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়’। এবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে দাঁড়ানো কী প্রমাণ করে?
মনিরুল হক: হ্যাঁ, আমি অহনও এইটা মানি যে, ব্যক্তির থেইক্যা দল বড়, দলের থেইক্যা দেশ বড়। আমি কুমিল্লাকে বাঁচানোর লাইগা এইটা (নির্বাচন) করছি। এটা যদি পার্লামেন্ট নির্বাচন হইত, আর আমি দাঁড়াইতাম, তাহলে দলের সঙ্গে বেইমানি করতাম।
বিএনপির উদ্দেশে আপনার বক্তব্য কী?
মনিরুল হক: আমি তো এত বড় নেতা না যে দলের উদ্দেশে কিছু বলব। আমি বিএনপিকে ভালোবাসি, আর বিএনপিকে যারা ভালোবাসে, আমি তারার লগে আছি। এই জনগণের কেউ নেই আমি ছাড়া।
প্রথম আলো: আপনার প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আরফানুল হক দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন, এমনকি ‘চোর’ শব্দটিও প্রয়োগ করেছেন।
মনিরুল হক: চোর নির্ধারণ হয় ক্যামনে? চোর নির্ধারিত হয় কোর্ট-কাচারিতে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আছে—তারার কাজ কী? ওনার যদি এভিডেন্স থাকে, দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ তো নির্বাচনের পরের কথা, এখন একটা কেইস করে দেয় না কেন? ওনারা তো অনেক ক্ষমতাবান।