ডিসেম্বরে হতে পারে জাতীয় সম্মেলন। সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন এক ডজনের বেশি নেতা।
আবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের হাওয়া উঠেছে। আগামী ডিসেম্বরে হতে পারে নেতৃত্ব নির্বাচনের এ আয়োজন। প্রতিবারের মতো এবারও মূল আলোচনা সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে। টানা দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন ওবায়দুল কাদের। এবার এ পদে বদল আসছে—এটা ধরে নিয়ে দলের ডজনখানেক নেতা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় থাকার গত ১৩ বছরে দলের জাতীয় সম্মেলন হয়েছে তিনবার। প্রতিবারই নেতৃত্ব নির্বাচন হয়েছে সমঝোতার ভিত্তিতে; গোপন ভোটে নয়। সম্মেলনের আগে কোনো পদে কেউ আনুষ্ঠানিক প্রার্থিতা ঘোষণা দেননি, প্রচারেও নামেননি কেউ। তবে ভেতরে-ভেতরে কাঙ্ক্ষিত পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করেছেন নেতারা। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই মনে করছেন দলের নেতারা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দলের মাঠপর্যায়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রকট। ২০২৩ সালের শেষে কিংবা ২০২৪–এর শুরুতে জাতীয় নির্বাচন। সম্মেলন হলে নতুন কমিটি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ। ফলে আগামী নির্বাচনটা কেমন হবে? দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কাকে বসানো হবে? এসব নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এবারের সম্মেলন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলন থেকেই নির্বাচনের হাওয়া শুরু হবে।আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আ.লীগ
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও ঘনিষ্ঠ পরিসরে আলোচনা করছেন। সভাপতি পদে শেখ হাসিনাই থাকছেন, এটা নিশ্চিত। এর বাইরে এবার বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ দলের নেতৃত্বে আসতে পারেন—এমন আলোচনায়ও জোর পেয়েছে। অবশ্য আগের সম্মেলনগুলোতেও এই আলোচনা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আসেননি।
সামনে কেমন নেতৃত্ব আসছে—জানতে চাইলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখনো সময় বাকি আছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র জানায়, দল ও সরকারকে আলাদা রাখার বিষয়টিও গুরুত্ব পেতে পারে। অর্থাৎ যাঁরা মন্ত্রিসভায় আছেন, তাঁদের পারতপক্ষে দলের বড় পদে বিবেচনায় না নেওয়া। ২০১৯ সালের সম্মেলনেও এমন চেষ্টা দেখা গেছে। এ জন্য বেশ কয়জন কেন্দ্রীয় নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার পর দলের পদ হারান। ২০১৮ সালে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া অনেকে আবার দলের পদ পান।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলন হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। এ সম্মেলনে গঠিত কমিটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে।
নতুন করে আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন দুই সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ ও মির্জা আজম। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরীর নাম। তিনি সংসদীয় দলের সাধারণ সম্পাদক।
২ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় এক কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের জাতীয় সম্মেলন আগামী ডিসেম্বরে হওয়ার কথা। তিন বছর পরপর আমাদের সম্মেলন হয়, সেই হিসাবে আগামী ডিসেম্বরে আমাদের নির্ধারিত সময়। আমরা সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
২০০৯ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক হন প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এর আগে থেকেই বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এই পদে আসার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা ছিল। সৈয়দ আশরাফ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনের পর ওবায়দুল কাদের এই পদে আসেন ২০১৬ সালে। এখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। গত দুই সম্মেলনে ওবায়দুল কাদেরের পাশাপাশি দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের নামও জোরালোভাবে আলোচনায় ছিল।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ এবার সাধারণ সম্পাদক পদে আব্দুর রাজ্জাকের সম্ভাবনা দেখেন। এর বাইরে সাধারণ সম্পাদক হতে আগ্রহী আরও কয়েকজন নেতা নানাভাবে সক্রিয় আছেন। তাঁরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। কেউ কেউ দলের বিভিন্ন জেলার বিভেদ মেটাতে উদ্যোগী ভূমিকা রাখছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, দীপু মনি ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অতীতে সম্মেলনের দু-এক দিন আগে সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, সে বিষয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত দিতে দেখা গেছে। তবে আগে থেকেই অনেক নেতাকে বিভিন্ন সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়ে দেখতেন। এবারও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সমন্বয়ে দল গঠন করে সংগঠন গোছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। এটাকে দলীয় প্রধানের ‘পরখ করে দেখা’ হিসেবে দেখছেন নেতারা। এ জন্য সবাই সাধ্যমতো দৌড়ঝাঁপ করছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, গত জাতীয় সম্মেলনের আগে দলের সাংগঠনিক পর্যায়ের কয়েকজন নেতাও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় ছিলেন। এর মধ্যে বর্তমান নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী অন্যতম। এবার তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই। তবে আলোচনায় আছেন। নতুন করে আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন দুই সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ ও মির্জা আজম। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরীর নাম। তিনি সংসদীয় দলের সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগকে বিরোধীদের অপরাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, ভোটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়। আগামী সম্মেলনে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সক্ষম, সাহসী, ত্যাগী ও সৎ নেতাদেরই কাউন্সিলর ও ডেলিগেটররা নির্বাচিত করবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতি ঘটনাবহুল হতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। এ জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো নেতারা বিবেচনায় থাকবেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনিক বিষয়াদি এবং অভ্যন্তরীণ কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে দলের নেতাদের বড় ভূমিকা থাকে না। মাঠের বক্তৃতা, টিভির টক শোতে অংশ নিয়ে দলের পক্ষে কথা বলা, বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে দলকে ভালোভাবে প্রতিনিধিত্ব করাই জ্যেষ্ঠ নেতাদের বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এসবও বিবেচনায় নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, বর্তমান ৮১ সদস্যের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিষয়ভিত্তিক সম্পাদক পদে কিছু কিছু নেতা দীর্ঘদিন ধরে আছেন। তাঁদের অনেকে এবার বাদ পড়তে পারেন। কাউকে কাউকে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। আবার সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা নেতাদের কেউ কেউ এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ডিসেম্বরেই জাতীয় সম্মেলন হবে। এর প্রস্তুতি হিসেবে মাঠপর্যায়ে দল গোছানোর কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এবারের সম্মেলন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলন থেকেই নির্বাচনের হাওয়া শুরু হবে।
সামনে কেমন নেতৃত্ব আসছে—জানতে চাইলে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখনো সময় বাকি আছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।