‘ধর্ষণ বা গণধর্ষণ যা–ই হোক, তা শুধু একটি মেয়ের সঙ্গে হয়। তবে ওই ঘটনার পর থেকে কত প্রকার ও কতভাবে যে ধর্ষণের শিকার হতে হয়, তা শুধু ওই ভুক্তভোগী মেয়েটিই জানে। এ অভিজ্ঞতা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতেও পারবে না। আমি নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন চালু করেছি। আমার মতো যাঁরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আমি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাই। যদি সুযোগ পাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েই ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই।’
কথাগুলো বলছিলেন ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সিরাজগঞ্জে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হওয়া সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমা রানী শীল। ওই সময় নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোরী পূর্ণিমা এখন পূর্ণ বয়স্ক নারী। তিনি জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম তুলেছেন।
প্রথম আলো কার্যালয়ে বসেই কথা হলো পূর্ণিমার সঙ্গে। এর আগে তিনি সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ (পারসোনাল অফিসার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ধর্ষণের ঘটনার পর, গত বছরের ১৭ জানুয়ারি ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর এবং মনোনয়ন ফরম কেনার পর আবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। আর মাঝের সময়গুলোতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেক মানুষ। তবে ধর্ষণের শিকার হওয়ায় মনের কষ্ট ও ক্ষোভ কি আর এত সহজে কমে? তাই আলাপে উঠে আসে অনেক কথা।
সংরক্ষিত আসনের সাংসদ হতে চাওয়া প্রসঙ্গে এই নারী বললেন, ‘মনোনয়ন ফরম কেনার ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে মাইনরিটিজ অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের সদস্যরা বলেছেন তাঁরা হিন্দু সম্প্রদায় এবং নির্যাতনের শিকার একজনকে সংসদে দেখতে চান বলেই এ সহায়তা করেছেন। তবে ফরম কেনার পর থেকে শুধু হিন্দু নয়, সব সম্প্রদায়ের মানুষ আমাকে সাহস জোগাচ্ছেন, যা দেখে খুবই ভালো লাগছে। সংসদে যেতে পারব কি না জানি না, তবে মানুষের যে ভালোবাসা পেলাম, তা ভেবেই ভালো লাগছে।’
তথ্য প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পূর্ণিমা বলেন, ‘আমার বসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো চেয়ার ছিল না। বলা যায়, বারান্দায় বসেই অফিস করতে হতো। তবে মাস শেষে নিয়মিত ভালো বেতন পেতাম। হুট করে এ চাকরি চলে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছি। এ চাকরি হওয়ার আগে আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। চাকরি পাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, সরকারি চাকরি, যদি স্থায়ী কাজ পাই, তাহলে আর চিন্তা করতে হবে না। তখন জানতামও না যে এ চাকরির নিয়মটাই এমন। এখন হন্যে হয়ে আবার চাকরি খুঁজছি। তারানা আপা আমাকে চাকরিটি দিয়েছিলেন। সে জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
ধর্ষণের শিকার হলেও পড়াশোনা ছাড়েননি পূর্ণিমা। জানালেন, ঢাকায় বিভিন্ন মানুষের বাসায় থাকতে গেলে এক-দুই দিনের বেশি কেউ জায়গা দিতে রাজি হতেন না। ভয় পেতেন। এসব সংগ্রামের মধ্য দিয়েই নবম শ্রেণির পর পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেন। ২০০৫ সালে বাবা প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। চার বোনের মধ্যে তিনজনের বিয়ে হয়েছে। পাঁচ ভাই পারিবারিক পেশায় আছেন। ২০০১ সালের পর পরিবারটির ওপর নেমে আসে নানা দুর্ভোগ। ঘটনার ১৪ দিন পর ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন বাবা। মামলার রায়ে ১১ জনের যাবজ্জীবন এবং ১ লাখ টাকা করে জরিমানা হয়েছে। আসামিদের অনেকেই এখন জামিনে আছেন।
পূর্ণিমা বললেন, ‘আমার ঘটনার পর আমার দাদাদের বিয়েতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। এমন পরিবারে মেয়ে দিতে চাইতেন না অনেকে। তবে সাহারা খাতুন, ইফতেখারুজ্জামান, শাহরিয়ার কবীর, মরহুম বেবী মওদুদসহ অনেকেই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং এখনো পাশে আছেন। ২০০৩ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে পড়াশোনার জন্য ২ হাজার করে টাকা পেয়েছি। অন্যরাও আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন।’
পূর্ণিমা মনে করেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তিনি তো এ জন্য দোষী না। এখন নিজের পরিচয় দিতে লজ্জা পান না। তবে আক্ষেপ, ধর্ষণের ঘটনার ১৫ বছর পরও তাঁর নাম ও ফোন নম্বর দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে খোলা হয়েছিলো পর্নোগ্রাফি–সংবলিত পেজ। এতে করে তাঁকে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। বর্তমানে বাধ্য হয়েই তিনি অন্য নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন।
বর্তমানে এই নারী আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৬১টি সমাবেশে অংশ নেন।