সাত ধাপের ইউপি নির্বাচন

শেষ ধাপে আরও পেছাল আ.লীগ

  • আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করা বিদ্রোহীরা জিতেছেন ৯১১টি বা ২২ শতাংশ ইউপিতে।

  • বিএনপি নেতারা জয় পেয়েছেন ৩৪৯টি বা ৮ শতাংশ ইউপিতে।

  • স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩১৩টি বা ৮ শতাংশ ইউপিতে জয়ী।

আওয়ামী লীগের দলীয় লোগো

সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আগের সব ধাপের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। নিজ দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের থেকেও পিছিয়ে আছে তারা। গত সোমবার অনুষ্ঠিত সপ্তম ধাপের নির্বাচনে ১৩৬টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মাত্র ৩৭টিতে জয় পেয়েছেন। বিপরীতে বিদ্রোহীরা জয় পেয়েছেন ৩৯টিতে।

সারা দেশ থেকে পাঠানো প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাত ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ক্রমান্বয়ে খারাপ ফল করেছেন। প্রথম ধাপে ৭৩ শতাংশ ইউপিতে জয়ী হলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা দ্বিতীয় ধাপে ৫৮, তৃতীয় ধাপে ৫২, চতুর্থ ধাপে ৪৭, পঞ্চম ধাপে ৪৮, ষষ্ঠ ধাপে ৫৩ এবং সপ্তম ধাপে মাত্র ২৭ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছেন।

প্রথম ধাপে ৭৩% ইউপিতে জয়ী হলেও শেষ ধাপে এসে মাত্র ২৭% ইউপিতে জয়ের মুখ দেখেছে আওয়ামী লীগ।

এ পর্যন্ত সারা দেশে ৪ হাজার ১১১টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ২ হাজার ১৭০টি ইউপিতে (৫৩ শতাংশ) জিতেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ৩৬৮ জন, অর্থাৎ ৯ শতাংশ প্রার্থীর প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতা। সে হিসাবে সাত ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় ২ হাজার ৫৩৮টি বা ৬২ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছে।

এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করা বিদ্রোহীরা জিতেছেন ৯১১টি বা ২২ শতাংশ ইউপিতে। এদিকে বিএনপি থেকে স্বতন্ত্র হিসেবে জয় পেয়েছেন ৩৪৯ জন (৮%) প্রার্থী। দলীয় মনোনয়নের বাইরে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করে সারা দেশে বিজয়ী হয়েছেন ৩১৩ জন (৮%)।

তবে সপ্তম ধাপের ইউপি নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হিসাব বলছে, ১৩৮টি ইউপির মধ্যে ৮৫টিতেই জয়লাভ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ৮৫টির মধ্যে ২৪টি ইউপিতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বাকি ৬১টি ইউপিতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও হতে পারেননি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ইসি সূত্রে গতকাল মঙ্গলবার এসব তথ্য জানা যায়। ইসি সূত্র জানায়, সপ্তম ধাপের ভোটে ৩২টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। এর বাইরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করা ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই আওয়ামী লীগের।

আ.লীগ ‘বনাম’ বিদ্রোহী প্রার্থী

সাত ধাপের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা অর্ধেকের বেশি ইউপিতে জয়লাভ করেছেন। ৪ হাজার ১১১টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা ২ হাজার ১৭০টি ইউপিতে, অর্থাৎ ৫২ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছেন। প্রথম ধাপে ৩৬৯টির মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছিল ২৬৯টি বা ৭৩ শতাংশ ইউপিতে। ওই ধাপে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র থেকে বিজয়ী প্রার্থীদের নাম পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল অর্ধেকের বেশি ইউপিতে জয় পায়। ওই ধাপে ৮৩৩টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪৮৫টিতে জয়ী হয়েছিল, বিদ্রোহীরা জয় পেয়েছিলেন ২০৬টিতে। অর্থাৎ দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগ ৫৮ শতাংশ ইউপি নিজেদের দখলে নিতে পেরেছিল। বিপরীতে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা ২৫ শতাংশ ইউপির নিয়ন্ত্রণ তাঁদের দখলে রাখেন।

তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫২৫টি ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা ২৭০টিতে জয় পান। অর্থাৎ ৫২ শতাংশ ইউপিতে আওয়ামী লীগ, আর ২৭ শতাংশ ইউপিতে বিদ্রোহীরা জয়ী হন। চতুর্থ ধাপে এসে অর্ধেকের কম ইউপিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। ৮৪০টির মধ্যে ৩৯৬টি, অর্থাৎ ৪৭ শতাংশ ইউপিতে নিজেদের জয় নিশ্চিত করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। আর বিদ্রোহীরা ১৯৭টি, অর্থাৎ ২৩ শতাংশ ইউপিতে জয়লাভ করেন।

পঞ্চম ধাপে এসেও আওয়ামী লীগ অর্ধেকের মতো ইউপিতে তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। ৭০৭টির মধ্যে ৩৪১টিতে, অর্থাৎ ৪৮ শতাংশ ইউপিতে জয় পায় দলটি। আর বিদ্রোহীরা জয় পান ১৬০টি বা ২৩ শতাংশ ইউপিতে। ষষ্ঠ ধাপে ২১৯টি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১১৭টিতে, বিদ্রোহীরা ৩৯টিতে জয় পেয়েছিলেন। সে হিসাবে ওই ধাপে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ৫৩ শতাংশ, বিদ্রোহীরা ১৮ শতাংশ ইউপি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছিলেন। সর্বশেষ সপ্তম ধাপের নির্বাচন হয়েছে সবচেয়ে কম—১৩৬টি ইউপিতে। এই ধাপে বিদ্রোহীরা অবশ্য এগিয়ে আছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ৩৯টি, অর্থাৎ ২৮ শতাংশ ইউপিতে নিজেদের জয় নিশ্চিত করেছেন। আর ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ৩৭টি, অর্থাৎ ২৭ শতাংশ ইউপিতে।

স্বতন্ত্র হয়েও এগিয়ে বিএনপি নেতারা

বিএনপি এবারের ইউপি নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নেয়নি। তবে দলটির স্থানীয় নেতাদের অনেকেই চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করলেও ভোটের ফলে গতবারের (পাঁচ বছর আগে) চেয়ে ভালো করেছেন বিএনপির নেতারা। ২০১৬ সালে দেশে প্রথমবারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ছয় ধাপে মোট ৪ হাজার ১০৪টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি জয় পেয়েছিল ৩৬৭টি ইউপিতে। অর্থাৎ বিএনপি জয় পেয়েছিল ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ ইউপিতে। এবার ৪ হাজার ১১১টি ইউপিতে ভোট হয়েছে।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন ৩৪৯টি ইউপিতে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে বিএনপি নেতারা কতটিতে জয় পেয়েছিলেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। বাকি নির্বাচনগুলোর মধ্যে বিএনপি নেতারা দ্বিতীয় ধাপে ৬৪টিতে, তৃতীয় ধাপে ৯১, চতুর্থ ধাপে ৭৫, পঞ্চম ধাপে ৮৩, ষষ্ঠ ধাপে ২৫ এবং সপ্তম ধাপে ১১টি ইউপিতে জয়লাভ করেছেন। সে হিসাবে বিএনপি নেতাদের জয়ের হার ৮ শতাংশ।

আ.লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবি

সপ্তম ধাপের নির্বাচনে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। উপজেলার ১৭ ইউপির মধ্যে ৩টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বলছেন, দলীয় প্রতীকে উপযুক্ত প্রার্থী দিতে না পারা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় আওয়ামী লীগের এমন ফল বিপর্যয় হয়েছে।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বাকি ১৪ ইউপির মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ ৭ ইউপিতে জামায়াতের নেতারা বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ৪ ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং ৩টিতে বিএনপির নেতারা নির্বাচিত হয়েছেন।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার একটি ইউপিতে নির্বাচন হয়েছে। উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীর তিন গুণের বেশি ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা মো. ইন্তাজ আলী। জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ইউনিয়নের ৯টি কেন্দ্রে বিজয়ী উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইন্তাজ আলী ভোট পেয়েছেন ৬ হাজার ১০টি। আর আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবদুল মতিন পেয়েছেন ১ হাজার ৭৯০ ভোট। তাঁদের দুজনের ভোটের ব্যবধান ৪ হাজার ২২০টি।

খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার চেঙ্গী ইউপিতে নৌকার প্রার্থী মনীন্দ্র লাল ত্রিপুরা মাত্র ৯৬ ভোট পেয়ে জামানত খোয়াতে যাচ্ছেন। এই ইউপিতে আটজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জামানত খোয়া যাওয়ার ঘটনা আরও আছে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সাতটি ইউপির নির্বাচনে সব কটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। সাতটির মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ এবং তিনটিতে স্বতন্ত্র হিসেবে বিএনপির নেতারা নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে দুজন জামানত হারাচ্ছেন। উপজেলার বাদাঘাট ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. সুজাত মিয়া ৪৫৬ ভোট পেয়েছেন। প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে সুজাত মিয়া জামানত হারাচ্ছেন। বড়দল দক্ষিণ ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি ৭৬৯ ভোট পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে আছেন। প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে তিনি জামানত হারাচ্ছেন।

তাহিরপুর উপজেলার সব ইউপিতে নৌকার ভরাডুবি প্রসঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত প্রার্থী মনোনয়নে ভুলের কারণেই এখানে নৌকার এমন পরাজয় হয়েছে। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী দেওয়া হয়নি। দলের যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তাঁদের নাম আমরা তৃণমূল থেকে প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু তাঁরা মনোনয়ন পাননি।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]