রাজধানীতে কার্যত কোনো কৃষিজমি নেই, কৃষকও নেই। তবে এখানে কৃষক লীগের নেতা-কর্মীর কোনো কমতি নেই। রাজধানীতে কৃষক লীগের পদধারী নেতাই আছেন প্রায় ৮ হাজার।
সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কৃষকসমাজকে সংগঠিত করা এবং তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের জন্ম। যেহেতু ইট-পাথরের এই নগরে কৃষক নেই, সেহেতু তাঁদের সংগঠিত করার সুযোগও নেই। যে কৃষকদের স্বার্থে এই সংগঠন, তার কেন্দ্রীয় কমিটিতে কৃষক বা কৃষক সংগঠক নেই একজনও। নেতাদের বেশির ভাগেরই গ্রামে যাতায়াত কম।
যদিও এর নেতারা দাবি করেছেন, তাঁরা কৃষক না হলেও বেশির ভাগ কৃষকের সন্তান। তবে কৃষকের স্বার্থে এই কৃষক-সন্তানদের কোনো কর্মসূচি নেই। দিবসভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি আর আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে যোগ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাঁদের কার্যক্রম।
যেখানে কৃষক ও কৃষি নেই, সেখানে এই সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। মূল দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একাধিকবার প্রকাশ্য সমাবেশে এই প্রশ্ন তোলেন। রাজধানীতে গুলশান বা ধানমন্ডির মতো জায়গায় কেন কৃষক লীগ প্রয়োজন, তার কোনো সদুত্তর নেই সংগঠনটির নেতাদের কাছেও।
ঢাকায় কেন্দ্রীয় কমিটির পর মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ দুটি কমিটি আছে কৃষক লীগের। একেকটি কমিটি ৮১ সদস্যবিশিষ্ট। ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা কৃষক লীগ সূত্র জানায়, তাদের অধীনে গুলশান, বনানী, মিরপুর, পল্লবী, হাতিরঝিলসহ ২৭টি থানা কমিটি আছে। এসব কমিটিতে পদধারী নেতা আছেন ১ হাজার ৯১৭ জন। আর ওয়ার্ড কমিটি আছে ৪৬টি।
প্রতিটি ওয়ার্ড কমিটি ৬১ সদস্যবিশিষ্ট। সে হিসাবে মহানগর উত্তরে ওয়ার্ড পর্যায়ে পদধারী নেতা আছেন ২ হাজার ৮০৪ জন। তাঁদের সাংগঠনিক কাজ হলো দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠান করা এবং আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে অংশ নেওয়া।
সংগঠনের একাধিক সূত্র জানায়, যেসব নেতা মূল দলে জায়গা পান না, তাঁদের সন্তুষ্ট রাখতে সহযোগী সংগঠনগুলোতে পদ দেওয়া হয়। এতে তাঁরা একটা রাজনৈতিক পরিচয় পান। আর এসব পদ ব্যবহার করে অনেকে নানা রকম স্বার্থ হাসিল, ধান্ধা, তদবির করে থাকেন বলেও অভিযোগ আছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, রাজধানীতে এ ধরনের সংগঠনের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির ফল। কোনোভাবে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বা সাইনবোর্ড রাখা গেলে নানা ধরনের অন্যায় সুবিধা পাওয়া যায় এবং অন্যায় করে পার পাওয়া যায়। এ জন্য নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ ধরনের সংগঠন করা হয়।’
দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ
ঢাকা মহানগর উত্তর কৃষক লীগের সভাপতি মো. মাকসুদুল ইসলাম পেশায় পোশাকশিল্প ব্যবসায়ী। তবে তিনি নিজেকে কৃষকের সন্তান দাবি করেন। আর সাধারণ সম্পাদক আবদুল হালিম খানও ব্যবসায়ী। গত এক বছরে ঢাকা মহানগর কমিটি কৃষকদের জন্য কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। সংগঠনের সভাপতি মাকসুদুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা ১৫ আগস্ট উপলক্ষে স্বেচ্ছায় রক্তদান, ১ আষাঢ় (১৫ জুন) বৃক্ষরোপণ অভিযান, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, টুঙ্গিপাড়ায় তালগাছ রোপণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা করেছেন।
রাজধানীতে কৃষক লীগ কী কাজ করে, কাদের সংগঠিত করে-এমন প্রশ্নের জবাবে মাকসুদুল ইসলাম বলেন, কৃষকদের দাবিদাওয়া আদায়, বয়স্ক ভাতা, সারে ভর্তুকি ইত্যাদি বিষয়ে কেউ বঞ্চিত হচ্ছে কি না, এসব বিষয় তাঁরা কমিটিগুলোর মাধ্যমে খোঁজখবর করেন। তিনি দাবি করেন, ‘কৃষক লীগে কোনো ধান্ধা, চাঁদাবাজি নেই। এখানে সবাই ভদ্র ও নিরীহ।’
যদিও গত ২০ সেপ্টেম্বর কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের চেয়ারম্যান শফিকুল আলমকে ক্লাব থেকে অস্ত্র-গুলি, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে রS্যাব। এরপর তাঁকে কৃষক লীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ রকম অপকর্মে জড়িত আরও কেউ আছেন কি না, সেটা এখনো প্রকাশ পায়নি।
উত্তরের মতো কৃষক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই ব্যবসায়ী। তাঁদের অধীনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৪টি থানার মধ্যে ২০টি থানার কমিটি আছে। প্রতি কমিটিতে ৭১ জন করে এসব থানায় সদস্য আছেন ১ হাজার ৪২০ জন। আর ওয়ার্ড পর্যায়ে ২০টি ওয়ার্ডে কমিটি আছে। এসব কমিটিতে সদস্য আছেন কমবেশি ১ হাজার ২২০ জন।
সব মিলিয়ে রাজধানীতে কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ এবং ওয়ার্ডগুলো মিলিয়ে কৃষক লীগের পদধারী নেতা আছেন প্রায় ৭ হাজার ৯২০ জন। এই প্রায় আট হাজার নেতার অধীন কর্মী আছে কত, সে হিসাব পাওয়া যায়নি।
ঢাকায় কৃষক লীগের কমিটির প্রয়োজনীয়তা কী-এ প্রশ্নের জবাবে মহানগর দক্ষিণ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল রব খান প্রথম আলোকে বলেন, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় ঢাকা মহানগরে কমিটি প্রয়োজন আছে। এখান থেকে সারা দেশে সংগঠন সুফল পায়। তাঁরা কৃষকদের উপকার করার চেষ্টা করেন। আর নগরে কমিটি না থাকলে কর্মসূচি পালন করা যায় না।
কৃষকের আন্দোলনে দেখা যায় না
কেবল ঢাকায় নয়, অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও কৃষক লীগের কমিটি আছে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় তো রয়েছেই। অনেক এলাকায় ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক লীগের কমিটি আছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কৃষক লীগের মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ‘কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ মূলমন্ত্রে সারা দেশে কৃষকসমাজকে সংগঠিত করে কৃষক-জনতার স্বার্থ সংরক্ষণ করা। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবেও কৃষকদের সংগঠিত করতে বা তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণে কৃষক লীগকে কোনো কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না। সর্বশেষ ধানের দাম না পেয়ে কৃষকদের প্রতিবাদে যখন সারা দেশে আলোচনা তৈরি হয়, তখনো চুপ ছিল কৃষক লীগ।
মাঠপর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে কৃষক আন্দোলনে যুক্ত বাংলাদেশ কৃষক সমিতি খুলনা জেলার সভাপতি নিতাই গাইন। থাকেন খুলনার বটিয়াঘাটায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় দুই দলের কৃষক সংগঠনগুলো মূলত কমিটিসর্বস্ব। বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলো কৃষকের দাবিদাওয়া নিয়ে সাধ্যমতো আন্দোলন বা কর্মসূচি পালন করে থাকে। এসব কর্মসূচিতে কৃষক লীগ বা কৃষক দলকে পাশে পান না। তাঁর মতে, রাজধানী ঢাকায়, যেখানে কৃষি বা কৃষক নেই, সেখানে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কৃষক সংগঠন থাকার কোনো দরকার নেই। গ্রামে কৃষকেরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আছেন। তাই কৃষক সংগঠন দরকার গ্রামে।
নেতৃত্বে ব্যবসায়ী, আইনজীবী
কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ১১১ সদস্যের। সাবেক ছাত্রনেতা মোতাহার হোসেন মোল্লা এখন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি। তাঁর পেশা ঠিকাদারি ব্যবসা। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার শামসুল হক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির ১৬ জন সহসভাপতির মধ্যে সাতজন এবং সাত সাংগঠনিক সম্পাদকের চারজনই ব্যবসায়ী। কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য নেতাদেরও বড় অংশ ব্যবসায়ী। ১৫ জন আছেন আইনজীবী। একজন সাংবাদিক, কয়েকজন শিক্ষক এবং কৃষিবিদও আছেন। তবে কোনো কৃষক নেই কমিটিতে।
এ ব্যাপারে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরাসরি কৃষক কেউ কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই, এটা ঠিক। তবে তাঁর (শামসুল হক) গ্রামের বাড়িতে কৃষিকাজ হয়। সংগঠনের সভাপতিসহ এ রকম অনেকের গ্রামের বাড়িতেই কৃষিকাজ হয়। তিনি জানান, তাঁদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী আছেন। তবে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি নয়।
অবশ্য গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, যেকোনো কৃষক ও কৃষি পেশার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি, কৃষকদরদি বিশিষ্ট ব্যক্তি এই সংগঠনের সদস্য ও নেতৃত্বে আসতে পারেন।
কৃষক লীগের কর্মসূচির বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন, কৃষকদের সহায়তায় পরিকল্পনা নেওয়া এবং কৃষি উপকরণ, বয়স্ক ভাতাসহ এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা ও বিভিন্ন দাবিদাওয়া তুলে ধরে কৃষক লীগ। তবে খুব বেশি দাবি তুলতে হয় না। তার আগেই বেশির ভাগ প্রধানমন্ত্রী বাস্তবায়ন করে ফেলেন।
রাজধানী ঢাকায় কেন কৃষক লীগের এত কমিটি-এ প্রশ্নের জবাবে খোন্দকার শামসুল হক বলেন, বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং দাবিদাওয়া উত্থাপন করতে হলে শহরকেন্দ্রিক সংগঠন প্রয়োজন। এ কারণে রাজধানীতে সংগঠন করা হয়েছে, যাতে শহরের শিক্ষিত মানুষও যুক্ত হয়।
ঢাকা শহরে কৃষক না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এখানে কৃষক লীগ বা কৃষক দলের মতো সংগঠন কাজ করে, সে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি নিজেও একসময় কৃষক সংগঠন করতেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কৃষক সংগঠকেরা শহরে বড় হতে পারেন, মধ্যবিত্তের অংশ হতে পারেন। কিন্তু কৃষক সংগঠন করতে হলে তাঁকে অবশ্যই গ্রামে যেতে হবে। ঢাকা শহরে বসে কৃষক সংগঠন হতে পারে না।
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে একসময় কৃষক সংগঠন করেছি। তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে গ্রামে চলে গিয়েছি। কৃষকের পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে জেল খেটেছি। এখন যাঁদের কৃষকনেতা হিসেবে আমরা দেখি, তাঁরা কৃষকের স্বার্থে কী করেছেন, কোন দাবির পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
ঢাকায় এত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন
কৃষক লীগের নেতারা রাজধানীতে কৃষক সংগঠনের প্রয়োজন দেখলেও মূল দল আওয়ামী লীগেও এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। গত বছরের ৩০ এপ্রিল ঢাকা মহানগর উত্তর কৃষক লীগের এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন জায়গায় অহেতুক কৃষক লীগের কমিটি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই সভায় তিনি জানতে চেয়েছিলেন, সেখানে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কতজন কৃষক। অনেকে হাত তুলেছিলেন। তখন ‘না’সূচক মাথা নেড়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ঢাকায় বসে কৃষক! কৃষক লীগের ধানমন্ডি, গুলশান, কুয়েত, কাতার, নিউইয়র্ক শাখার কী দরকার? যেসব জায়গায় দৃষ্টি দেওয়া দরকার, সেসব জায়গায় দৃষ্টি দিতে হবে।
এর আগে ২০১৭ সালের ১২ মার্চ শ্রমিক লীগের এক সমাবেশেও রাজধানীতে কৃষক লীগের কমিটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ওবায়দুল কাদের।
ঢাকার গুলশান-বনানীতে কৃষক লীগের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামে-গঞ্জে কৃষকদের সংগঠিত করতে কৃষক লীগের জন্ম হয়েছে। ঢাকায় কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে। কিন্তু আবাসিক এলাকায়, বিশেষ করে ঢাকা শহর বা বিভাগীয় শহরে কৃষক লীগের শাখা থাকার তো কোনো যুক্তি নেই। কমিটি করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে এটি বিবেচনায় রাখা উচিত।