রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকেই পার করেছেন নানা চড়াই-উতরাই। রাজনীতির হাতেখড়িটাও শৈশবেই। একসময় নিজেও নেমেছেন সক্রিয় রাজনীতিতে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ হয়ে আওয়ামী লীগ। দেশের রাজনীতির দীর্ঘ অধ্যায়জুড়ে ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম।
১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় এম মনসুর আলী ও মোসাম্মত আমেনা মনসুরের ঘরে মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম। জাতীয় চার নেতার একজন এম মনসুর আলী, যিনি পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে খুন হন। আর আজ ১৩ জুন না–ফেরার দেশে চলে গেলেন মোহাম্মদ নাসিম।
রাজনীতিতে প্রায় ৬ দশক
মোহাম্মদ নাসিম জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর তিনি যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। এরপর ১৯৮১ সালের সম্মেলনে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুব সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৭ সালে দলের প্রচার সম্পাদক হন নাসিম। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে পরপর দুবার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান নাসিম। ওই সময় দলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ একটি ছিল।
২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে কার্যনির্বাহী কমিটির ১ নম্বর সদস্য পদে ছিলেন নাসিম। এরপর ২০১২ সালের সম্মেলনে তাঁকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। টানা তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের মুখপাত্রের দায়িত্বে ছিলেন।
সংসদ ও সরকারে বারবার
১৯৮৬ সালে প্রথম সিরাজগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করে সাংসদ নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। ওই একই আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে ছয়বার জাতীয় সংসদে আসেন তিনি। ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। মাঝে মামলার কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁর ছেলে তানভীর শাকিল সাংসদ নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী হন মোহাম্মদ নাসিম। পরের বছর আরও একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। ডাক ও টেলিযোগাযোগের পাশাপাশি তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এরপর ১৯৯৯ সালে মন্ত্রিসভা রদবদল করা হলে তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ২০১৪ সালের সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের মন্ত্রিসভায় তাঁকে রাখা হয়নি। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয় তাঁকে।
আন্দোলন ও কারাবাস
রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল মোহাম্মদ নাসিমের। সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন সময় নির্যাতন সহ্য করেছেন। আলোচিত এক–এগারো সরকারের সময়েও গেছেন কারাগারে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর বাবার মতোই বঙ্গবন্ধু পরিবারের আস্থাভাজন ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর মাত্র আড়াই মাসের মাথায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। গ্রেপ্তার হন মোহাম্মদ নাসিম। এক–এগারো সরকারের দ্বিতীয় মাসেই আরও অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন নাসিম।
হাসপাতাল, করোনা শনাক্ত ও মৃত্যু
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ১ জুন রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। ওই দিন নমুনা পরীক্ষা করা হলে তাঁর করোনা শনাক্ত হয়। তাঁকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। ৫ জুন তাঁকে কেবিনে স্থানান্তরের পরিকল্পনা থাকলেও ওই দিন তিনি স্ট্রোক করেন। জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয় তাঁর। এরপর তিনি গভীর কোমায় চলে যান, লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় তাঁকে। গঠন করা হয় ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। এর মধ্যে ৮, ৯ ও ১০ জুন তাঁর নমুনা পরীক্ষা করা হলে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। বিদেশে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে পরিবার। কিন্তু ১১ জুন অবস্থার অবনতি হলে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন সবাই। ১২ জুন অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। তাঁর হৃদ্যন্ত্রে জটিলতা দেখা দেয়। পরদিন ১৩ জুন বেলা ১১টা ১০ মিনিটে তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করা হয়।
আগামীকাল রোববার সকালে বনানী কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে সমাহিত হবেন মোহাম্মদ নাসিম।