>
- আর্থিক কেলেঙ্কারি
- টাকা ফেরত দিতে না পারায় বিপাকে আছে বিআইএফসির আমানতকারীরা।
- অথচ কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
একজন ব্যক্তিই ধ্বংস করে দিয়েছেন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি। এতে পুরো প্রতিষ্ঠানটিই কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না, অন্য কেউ তাদের সঙ্গে লেনদেনও করছে না।
প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (বিআইএফসি)। এটি একটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর ব্যক্তিটি হচ্ছেন রাজনৈতিক দল বিকল্পধারার মহাসচিব আবদুল মান্নান। তিনি বিআইএফসির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। বিআইএফসিতে তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার প্রায় ৬২ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি জনগণ থেকে আমানত নিয়েছে, আবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও ঋণ নিয়েছে। আর বিআইএফসির দেওয়া ঋণের প্রায় ৮০ শতাংশই নিয়েছে আবদুল মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব ঋণ খেলাপি হওয়ায় গ্রাহকেরা এখন টাকার জন্য বিআইএফসিতে ভিড় করছেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চিঠি দিচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজই হচ্ছে না। এর ফলে দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান শীর্ষ খেলাপির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এর এর পুরো দায় আবদুল মান্নানের।
যেভাবে ঋণ বিতরণ
মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও তাঁর সানম্যান গ্রুপ বিআইএফসির ৬২ শতাংশ শেয়ারের কর্ণধার হওয়ায় ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিজে, পরিবারের সদস্য ও গ্রুপের কর্মকর্তাদের পরিচালক বানিয়ে বিআইএফসি পরিচালনা করতেন। আর এ সময়ই বিভিন্ন কায়দায় বড় অংশের টাকা বের করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন, বিআইএফসির বার্ষিক প্রতিবেদন, স্বতন্ত্র নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে সানম্যান গ্রুপকে দেওয়া ঋণের কোনো অর্থই আদায় হয়নি। সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কাজ হয়নি। বার্ষিক প্রতিবেদনে সানম্যান গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ৫৪ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব ঋণের সঙ্গে সাবেক পরিচালক আবদুল মান্নান জড়িত। আর এ ঋণ বিতরণের সময় বিআইএফসির চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান।
সবশেষ হিসাবে, বিআইএফসির ৮৩৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে আবদুল মান্নানসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে পাওনা প্রায় ৬২১ কোটি টাকা। এর পুরোটাই খেলাপি। তবে সুদসহ হিসাব করলে, আবদুল মান্নানের কাছেই আটকা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
ঋণ জালিয়াতির এসব ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়লে ২০১৫ সালের ১ জুলাই বিআইএফসির তৎকালীন চেয়ারম্যান উম্মে কুলসুম মান্নান এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানান, অনিয়মের দায়ভার কোম্পানির এবং পরিচালকদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির যেসব অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে, তা যথাযথ।
তৎকালীন এমডি ইনামুর রহমানও জানান, পর্ষদের কিছু পরিচালকের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় কিছু ঋণ বিতরণ করতে হয়।
শুরুতে অবশ্য চাপে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন আবদুল মান্নান। সে সময় অর্থাৎ ২০১৫ সালেই এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অগ্রগতির এখন পর্যন্ত খবর মেলেনি। ২০১৫ সালেই উম্মে কুলসুম মান্নান, তাঁর দুই পরিচালক মেয়েকে বিআইএফসি থেকে অপসারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৬ সালের ২৪ মার্চ এক চিঠিতে আবদুল মান্নান গভর্নরকে জানান, ‘আমি এসব ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিচ্ছি। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আরও ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হবে।’ এ জন্য তিনি দুদকে দেওয়া চিঠি উঠিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন গভর্নরকে। তবে ১০০ কোটি টাকা দিলেও পরে আর কোনো টাকা দেননি তিনি।
আবার বিএফআইসিকে বিলুপ্ত বা অবসায়ন করতে মতামত চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কেও চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্তই জানায়নি।
বিআইএফসির বর্তমান এমডি (চলতি দায়িত্বে) মোস্তফা বিলাল গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল মান্নান বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও টাকা দিচ্ছেন না। ব্যাংক, গ্রাহক কাউকেই টাকা দিতে পারছি না আমরা। কেউ আমাদের সঙ্গে লেনদেনও করছে না। তিনি টাকা ফেরত দিলেই আমরা কার্যক্রম শুরু করতে পারি।’
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়া একটি প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিতে পারছে না, এটা দুঃখজনক। এখন ব্যাংকগুলোও টাকা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট হবে।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এভাবে তো চলতে পারে না। যত আইনিপ্রক্রিয়া আছে, সব প্রয়োগ করতে হবে। কারণ, এর ফলে পুরো আর্থিক খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
গ্রাহকেরা এখন কোথায় যাবেন, এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্যোক্তারাই প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট করেছে। আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছি, পরবর্তী সময়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তারা কাজ করছে।’
বিষয়টি নিয়ে আবদুল মান্নানের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। খুদে বার্তা পাঠানোর পরে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
কেন কিছু হচ্ছে না
নানা ধরনের অনিয়ম করে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও সরকারের কোনো সংস্থাই আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক দুদককে ব্যবস্থা নিতে বললেও তা তেমন আর এগোয়নি। জানা গেছে, সরকারি নানা মহলে যোগাযোগ রক্ষা করে তিনি সবকিছুর ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তবে মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ শুরু হলে কিছু পরেই আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর দুদকে তলব করা হলেও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন জানিয়ে সময়ের আবেদন করে রেখেছেন তিনি। গত বছরের শেষ দিকে মান্নানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল সিআইডি।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগটি নিয়ে কমিশন অনুসন্ধান করছে। এ জন্য তাকে ডাকা হয়েছিল। অসুস্থতার কথা জানিয়ে তিনি সময় চেয়েছেন।
এদিকে এর মধ্যেই তাঁর দল বিকল্পধারা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়নি। সরকারবিরোধী এই ফ্রন্টে অন্যতম শরিক দল বিএনপি। বিকল্পধারার চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে শক্তিধর হলে বড় অপরাধ করেও ছাড় পাওয়া যায়। এটা বর্তমান সময়ের সুশাসনের প্রচণ্ড অভাবকেই নির্দেশ করে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তাঁদের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ে। আবদুল মান্নানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।