মনোনয়ন দৌড়ে সাবেক সরকারি কর্মকর্তারাও

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনীতিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি বেশ কিছুসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা বিভিন্ন দল থেকে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করছেন। এমন অন্তত ৩১ জনের নাম আলোচনায় আছে, যাঁদের মধ্যে ২২ জন এবারই প্রথম মনোনয়ন দৌড়ে যুক্ত হয়েছেন। অন্যরা এর আগেও মন্ত্রী-সাংসদ ছিলেন বা আছেন।

অবসরপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তার মধ্যে আটজন সচিব, দুজন আইজিপি, দুজন উপাচার্য, পাঁচজন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সাবেক কূটনীতিক, সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও ইউজিসির বর্তমান একজন সদস্যও আছেন এই তালিকায়।

তাঁদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। কেউ কেউ আবার ক্ষমতাসীন দলের মিত্র জাতীয় পার্টির হয়েও নির্বাচন করার চেষ্টা করছেন। বিএনপির হয়েও চেষ্টা চালাচ্ছেন কয়েকজন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী যেসব সরকারি কর্মকর্তা চাকরি থেকে কমপক্ষে তিন বছর আগে অবসরে গেছেন, কেবল তাঁরাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এবার এই তিন বছরের বিধানও কমানোর চেষ্টা করেছিলেন একদল সরকারি কর্মকর্তা। যদিও শেষ পর্যন্ত সফল হননি।

 আ.লীগের মনোনয়ন চান যাঁরা

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট ও মাধবপুর) আসন থেকে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব ছিলেন। হবিগঞ্জ-৪ আসনের বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের মাহবুব আলী।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং সাবেক সচিব নূর মোহাম্মদ কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। মাঠেও তিনি সরব আছেন। এই আসনের বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের মো. সোহরাব উদ্দিন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন চাঁদপুর-১ (কচুয়া) থেকে নির্বাচন করতে চান। এই আসনের বর্তমান সাংসদ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও সাবেক সচিব।

সিলেট-১ (সদর) আসনের বর্তমান সাংসদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও সাবেক আমলা।

তবে এইচ এম এরশাদের আমল থেকেই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, এবার আর নির্বাচন করবেন না। এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করতে চান অর্থমন্ত্রীর ভাই জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে এ মোমেন। 

একই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইনও। দলীয় মনোনয়ন ফরমও কিনেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসন থেকে নির্বাচনের জোর চেষ্টা করছেন। এ জন্য তিনি এলাকায় জনসংযোগ করছেন। তিনি দলীয় মনোনয়ন ফরমও জমা দিয়েছেন। তিনি এখন কুমিল্লা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এই আসনের বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের আলী আশরাফ।

প্রাণ গোপাল দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লার চান্দিনায় স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নয়ন, মাদক নির্মূল করাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করার জন্য জনপ্রতিনিধি হতে চান। তবে তিনি চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন।

বিএসএমএমইউর আরেক সাবেক উপাচার্য কামরুল হাসান খান টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) থেকে নির্বাচন করতে চান। তিনি টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাও। এই আসনের বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের আমানুর রহমান খান, যিনি হত্যা মামলার আসামি হয়ে কারাগারে। এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে আরও কয়েকজন মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন।

সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব ও বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন ফরিদপুর-১ (আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী ও মধুখালী) আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে এই আসনের বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমানও প্রভাবশালী প্রার্থী। এ ছাড়া আরও একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন এখানে।

 বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বর্তমান সদস্য অধ্যাপক এম শাহ্ নওয়াজ আলী রংপুর-২ (তারাগঞ্জ-বদরগঞ্জ) আসন থেকে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে নির্বাচন করতে চান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক এর আগে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের উন্নয়ন ও জনসেবার জন্য রাজনীতিই হচ্ছে বড় মাধ্যম। এ জন্য তিনি নির্বাচন করতে চান। এই আসনের বর্তমান সাংসদ আবুল কালাম মো. আহ্সানুল হক চৌধুরীও মনোনয়ন দৌড়ে আছেন।

বরগুনা-১ (বরগুনা সদর, আমতলী ও তালতলী) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন।

সাবেক সচিব মো. রশিদুল আলম এবার কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের ভাই। যদিও কুষ্টিয়ার এই আসনের বর্তমান সাংসদ হলেন ১৪ দলের শরিক জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

দিনাজপুর-৪ আসনের সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও সাবেক কূটনীতিক। তিনি এবারও সম্ভাব্য প্রার্থী। রংপুর-৫ আসনের বর্তমান সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীও সাবেক আমলা। তাঁরা এবারও মনোনয়নপ্রত্যাশী।

চাঁদপুর-৫ আসনের সাংসদ মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম ও কুমিল্লা-১ আসনের সাংসদ  মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবারও মনোনয়নপ্রত্যাশী।

 বিএনপির মনোনয়ন চান যাঁরা

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এস এম আবদুল হালিম বিএনপির হয়ে জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। তিনি দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। সাবেক আইজিপি এম এ কাইয়ুম জামালপুর-১ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

সাবেক সচিব হায়দার আলী শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) থেকে, লে. কর্নেল (অব.) আবদুল লতিফ নওগাঁ-৫ (সদর) থেকে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাসিরউদ্দিন আহমেদ ফেনী-৩ থেকে, সাবেক সচিব মুশফিকুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া), সাবেক সচিব আবু হেনা রাজশাহী-৪ (বাগমারা), সাবেক সচিব খান মোহাম্মদ ইব্রাহীম হোসেন সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর) ও মেজর (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসন থেকে বিএনপির ​মনোনয়ন চান।

মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী ঢাকা-১৭ (গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট) থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন বলে দলে আলোচনা আছে।

সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনে নির্বাচন করতে চান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ধানের শীষ প্রতীকে, না হয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব।’ 

জাতীয় পার্টি

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এন এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া গাজীপুর-২ (সদর ও টঙ্গী) আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করতে চান। এক-এগারোর সরকারের আলোচিত সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ফেনী-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনলেও কয়েক দিনের মাথায় জাতীয় পার্টিতে যোগ ​​দেন। জাতীয় পার্টি থেকে তাঁর মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত। আওয়ামী লীগ এই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিতে পারে বলে আলোচনা আছে।

 আলোচনা-সমালোচনা

সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতিতে আসা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। গত ৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বড় পদে চাকরি শেষে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রবণতার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এখন রাজনীতি হয়ে গেছে গ্রামের ‘গরিবের বউয়ের মতো’। এখানে কোনো নিয়মনীতি নেই। যাঁর যখন, যেভাবে ইচ্ছা রাজনীতিতে ঢুকছেন। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটি অন্যতম বাধা। এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের চিন্তাভাবনা করা উচিত।

আগামী সংসদ নির্বাচনে রাজনৈ​তিক দলগুলোর মনোনয়ন দৌড়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদেরও যুক্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কর্মকর্তা অবসরে গেলে তাঁর নির্বাচন করার অধিকার আছে। তবে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ মূলত রাজনীতিকদের হাতেই থাকা উচিত।