একটি নির্বাচনের প্রচার চলার সময় কী হয়? প্রার্থীদের প্রচার, তাঁদের মধ্যে বাহাস, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পাল্টা–প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি—সব নির্বাচনের অনুষঙ্গ। কখনো সংবাদ হয় নির্বাচনী সংঘাতও। কুমিল্লার নির্বাচনে এই সবকিছুই ছাপিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে থাকা এক ব্যক্তিকে নিয়ে হয়েছে বিস্তর আলোচনা। তিনি কুমিল্লা–৬ আসনের (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন, সেনানিবাস এলাকা) সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন। নির্বাচনকালে এলাকায় তাঁর থাকা নিয়েই বিতণ্ডার উদ্ভব। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে গেছে। তাঁকে কমিশন এলাকা ছাড়ার জন্য বলেছে, কিন্তু নাছোড় বাহাউদ্দিন এলাকা ছাড়েননি। তাঁকে এলাকা থেকে বের করতে না–পারা এখন নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। তাঁর মতো ‘ইজ্জতদার’ মানুষকে টেনেহিঁচড়ে বের করা যায় না, হতাশ নির্বাচন কমিশনারের কাছে থেকে এমন বক্তব্যও এসেছে।
সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর বাড়ি কুমিল্লা নগরের মুন্সেফবাড়িতে।
রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে আ ক ম বাহাউদ্দিনকে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করার জন্য ৮ জুন বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন নির্দেশ দেয়। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব (নির্বাচন পরিচালনা-২) মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে ওই তথ্য জানানো হয়।
নির্বাচন কমিশনের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ করার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬-এর ২২ বিধি অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সম্প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন অত্যন্ত কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করছেন, যা সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালার লঙ্ঘন। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে তদন্ত করালে লিখিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, যা মোটেই কাম্য নয়।
তবে বাহাউদ্দিন নড়েননি। তাঁর এই অনড় অবস্থান নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম ভোট হচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে। এ জন্য এই নির্বাচনকে নতুন ইসির জন্য ‘পরীক্ষা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু প্রথম পরীক্ষাতেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে এই কমিশন।
প্রশ্ন তৈরি হয়েছে এ কারণে যে ‘কৌশলে’ নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ায় ইসি কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। তারপরও তিনি এলাকায় অবস্থান করেন। কিন্তু কমিশন কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। উল্টো সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল গত রোববার সংসদ সদস্যকে নিয়ে কমিশনের অসহায়ত্বের কথা বলেন। আর গত সোমবার বিষয়টি নিয়ে দুই নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ও রাশেদা সুলতানা কুমিল্লায় সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন। তাঁরা বলেছেন, একজন সম্মানিত লোককে টেনেহিঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়।
বাহাউদ্দিনের এ অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছেন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সদ্য বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক ওরফে সাক্কু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ডাইরেক্ট বলছেন, একজন সংসদ সদস্যকে এলাকা থেকে বাইর করা ওনাদের কাজ না। তাহলে দায়িত্বটা কার? আমি তো আইন এত জানি না। আইনে যদি না থাকে, তাইলে এমপি সাব থাকব।’
বাহাউদ্দিনের এই অবস্থান যে তাঁকে অনেকটাই সুবিধা দেবে, তা বলেছেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের (বাহাউদ্দিন) সমর্থন বাড়তি পাওনা কি না—প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের জবাবে আরফানুল হকের উত্তর ছিল, ‘বাড়তি পাওনা আমার সব কাজের জন্য। কুমিল্লার মানুষের যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলোর সমাধানের জন্য আমি ওনার সঙ্গে পরামর্শ করব এবং আমার বিশ্বাস, আমার একজন মুরব্বি হিসেবে কুমিল্লার মানুষের আস্থার জায়গা উনি। উনি আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন।’