চতুর্থ ধাপের ভোটে ১৬২টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিলেন না।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে এসে ‘বিদ্রোহী’ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে আরও কোণঠাসা হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। চতুর্থ ধাপের ভোটে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীদের প্রায় অর্ধেকই হেরেছেন। এর মধ্যে ১৬২টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নৌকার প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিলেন না।
স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করেছে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। তারপরও প্রতিটি ধাপেই নৌকার জয়ের হার ক্রমান্বয়ে কমেছে। বেশ কিছু ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসা দূরের কথা, জামানত রক্ষা করার মতো ভোটও পাননি নৌকার প্রার্থীরা। কয়েকটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীরা ১০০ ভোটেরও কম পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর। এই জেলার বোয়ালমারী উপজেলায় নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। বোয়ালমারীর ১০টি ইউনিয়নের ৯টিতেই নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন। এর মধ্যে জামানত রক্ষা করার মতো ভোটই পাননি আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থী। এর আগে তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসনের ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিতেই পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীকুল মীরদাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের এ ফলাফলে লজ্জা পেয়েছি, আমার তো বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। কাউকে মুখ দেখাতেও পারছি না।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, তাঁরা প্রতিটি ইউনিয়নে সম্ভাব্য প্রার্থীদের কার অবস্থান কেমন, তা কেন্দ্রকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তা আমলে নেওয়া হয়নি।
নির্বাচনের এ ফলাফলে লজ্জা পেয়েছি, আমার তো বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। কাউকে মুখ দেখাতেও পারছি না।পীকুল মীরদাহ, সাধারণ সম্পাদক, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগ
স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের পক্ষে সম্মিলিতভাবে কাজ না করায় বোয়ালমারীতে এমন ফল হয়েছে বলে মনে করেন ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, মধুখালী) আসনের সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলাদলি ও নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ কাজ করেছে। পাশাপাশি এলাকার রাজনৈতিক মেরুকরণ ও গোষ্ঠীস্বার্থ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তৃণমূল থেকে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের ভেতর থেকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। প্রার্থী ভালো হয়নি, এটা একটা অজুহাত।
চতুর্থ ধাপে গত রোববার দেশের ৮৩৬টি ইউনিয়নে ভোট হয়। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় গতকাল সোমবার ৭৯৬টি ইউনিয়নের ফলাফলের তথ্য দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ৩৯৬টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৩৯০টিতে। বাকি ইউনিয়নে অন্য দলের প্রার্থীরা জিতেছেন।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১৯৭ জন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। তাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন বিএনপির ৭৫ জন নেতা।
চতুর্থ ধাপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর ছাড়াও রাজবাড়ী, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ধরাশায়ী হয়েছেন।
চতুর্থ ধাপের ভোটে ২৭টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিল না। সে হিসাবে এই ধাপে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ ইউপিতে। জয়ের এই হার এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চার ধাপের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে প্রথম ধাপে দুই দফায় এ বছরের এপ্রিল ও জুন মাসে ৩৬৫টি ইউপিতে ভোট হয়েছিল। প্রথম ধাপের ভোটে ৭৬ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। গত ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপে ক্ষমতাসীনেরা জয় পেয়েছিলেন প্রায় ৫৯ শতাংশ ইউপিতে। গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে ৫৪ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছিলেন ক্ষমতাসীনেরা।
এর আগে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জয়ের হার এবারের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের চেয়ে ভালো ছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। অবশ্য সে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল। ২০১৬ সালে ছয় ধাপে মোট ৪ হাজার ১০৪টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ২ হাজার ৬৫২টি, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছিল।
চতুর্থ ধাপের ভোটের ফল নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে প্রথম আলোর এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরের অবস্থান হচ্ছে আওয়ামী লীগ থেকে যাঁরা মনোনয়নবঞ্চিত, তাঁদের। বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচন না করলেও দলটির নেতারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছেন। বিএনপি ঘরানার প্রার্থীদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন জয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে সেটি আরও কম। তথ্যমন্ত্রীর মূল্যায়ন হচ্ছে, ইউপি ভোটে প্রমাণিত হয়েছে, দেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প আওয়ামী লীগই, অন্য কোনো বিকল্প নেই।
পাবনায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। জেলা সদরের ৯ ইউনিয়নের সব কটিতে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন। জেলার আটঘরিয়া উপজেলার ৫ ইউনিয়নের ৩টিতে ও ভাঙ্গুরা উপজেলার ৪টি ইউপির দুটিতে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। স্থানীয় নেতারা ভোটে ভরাডুবির জন্য প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয়নি।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল রহিম প্রথম আলোকে বলেন, দলে কোন্দল নেই। এরপরও কেন ইউপি ভোটে দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হেরে গেলেন, বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।
ঝিনাইদহ সদরের ১৫ ইউপির ১০টিতে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। আর ৫টিতে জয় পেয়েছে নৌকা। প্রায় একই অবস্থা হয়েছে লক্ষ্মীপুরেও। জেলার সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং ১টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। মাত্র ৬টি ইউপিতে নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার ৯ ইউপির মধ্যে ৭টিতেই নৌকা হেরেছে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে ৫টি ইউপির মধ্যে ৪টিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ১৫টি ইউপির মধ্যে ৯টিতে হেরেছে নৌকা।
চতুর্থ ধাপে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ভালো করলেও নৌকার ভরাডুবি হয়েছে রাঙামাটিতে। এই জেলার ১০টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে ৯টিতেই হেরেছে আওয়ামী লীগ। এখানে বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা আঞ্চলিক রাজনৈতিক কোনো দলের প্রকাশ্য কোনো প্রার্থী ছিলেন না।
ইউপি নির্বাচনে ফলাফল বিপর্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর বলেন, অস্ত্রধারীদের কারণে তাঁদের প্রার্থীরা সঠিকভাবে প্রচার চালাতে পারেননি। এ ছাড়া ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে।
তবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান বলেন, ১০ ইউনিয়নে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শাহ নেওয়াজ মাত্র ৬৭টি ভোট পেয়েছেন। ছয়জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে তিনি হয়েছেন ষষ্ঠ। এত কম ভোট প্রাপ্তির জন্য দলীয় নেতা-কর্মীরা কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সাংসদ জাফর আলমকে দায়ী করছেন।
এ ইউনিয়নে ৩ হাজার ৬৫৫ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জামাল হোসেন চৌধুরী। তিনি সাংসদ জাফর আলমের আত্মীয়। তিনি চিরিঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। এর আগে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে চকরিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী জান্নাতুল বাকেয়া পেয়েছিলেন মাত্র ৯৯ ভোট।
এত কম ভোট পাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহ নেওয়াজ বলেন, তাঁকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী তাঁর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেননি। সাংসদ জাফর আলমের ইশারা ও ভয়ভীতিতে দলীয় নেতা-কর্মীরা নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন। ফলে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে।
দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সাংসদ জাফর আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নির্বাচনের আগের দিন (২৫ ডিসেম্বর) আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সাংসদ জাফর আলমকে এলাকা ছাড়ার লিখিত নির্দেশনা দেয় নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচিত চেয়ারম্যান জামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, যোগ্য প্রার্থীকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ কারণে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে।
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাসুদ রানা ৭ হাজার ৪০৬ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। আর দলের প্রার্থী হাসিনা বেগম পেয়েছেন ৯৩ ভোট।
হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমার সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থীর হয়ে কাজ করেছেন।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]