চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের দিনে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ছবিতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের দিনে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ছবিতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে

ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ ভাড়ায় খাটেন তাঁরা

নির্বাচনে কেন্দ্র দখলে টাকার বিনিময়ে প্রার্থীদের পক্ষে ভাড়ায় খাটে একটি চক্র। ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ জনপ্রতি এক দিনের জন্য নেন ২০ হাজার টাকা। অস্ত্র ছাড়া হলে ১০ হাজার। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোটে সহিংসতায় জড়িত এক অস্ত্রধারীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য বেরিয়ে এল।

ওই আসামির নাম কামরুল আজাদ ওরফে সুমন (৩২)। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। কামরুল সাতকানিয়ায় নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের শাহ আলমের ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মারামারির তিনটি মামলা রয়েছে সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ থানায়।

গত বুধবার রাতে কামরুলসহ তিন অস্ত্রধারীকে নগরের লালদীঘি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বাকি দুজন হলেন শওকত হোসেন (৩২) ও আজাহার উদ্দিন (৩২)। তাঁদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তবে ভোটের দিন প্রদর্শন করা এই তিনজনের অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি।

চলতি বছরের গত ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সপ্তম ধাপের ইউপি নির্বাচনে সাতকানিয়ার পাশাপাশি দুটি ভোটকেন্দ্র—খাগরিয়ার ইউনিয়ন পরিষদ ও খাগরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আকতার হোসেনের পক্ষে অস্ত্র হাতে দেখা যায় তিনজনকে। কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিনের লোকজনের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। ওই সময় প্রথম আলোতে তাঁরাসহ আট অস্ত্রধারীর ছবি প্রকাশিত হয়।

পিবিআই সূত্র জানায়, ১৫ মাস আগে ২০২১ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি জেলার চন্দনাইশ পৌর নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষের লোকজনের মধ্যে গোলাগুলিতে এক কলেজছাত্র নিহত হওয়ার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তাঁদের তথ্য পাওয়া যায়। শুধু তা–ই নয়, ১৫ জুন বাঁশখালীতে অনুষ্ঠেয় ইউপি নির্বাচনে খাটার জন্য তাঁরা একটি ইউনিয়নের প্রার্থীর কাছ থেকে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকাও নেন সপ্তাহখানেক আগে।

পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান গতকাল শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, মূলত মহেশখালী, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় তৈরি দেশীয় অস্ত্র তাঁরা নেন। তাঁদের নিজেদের কাছে কিছু মজুত থাকে। চন্দনাইশ পৌরসভা ও সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউপি নির্বাচনে অস্ত্রবাজিতে ছিলেন তাঁরা। এ ছাড়া তাঁরা আরও সাত থেকে আটটি নির্বাচনে ভাড়ায় খেটেছিলেন।

২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চন্দনাইশ পৌরসভা নির্বাচনে গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে দুপুরে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবদুর রহিম ও আওয়ামী লীগ সমর্থক মো. সেলিম নামের দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের একপর্যায়ে গোলাগুলি হয়। কেন্দ্রের পাশে ছিলেন গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র হাবিবুর ইসলাম। গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর মা ছকিনা খাতুন বাদী হয়ে মামলা করেন চন্দনাইশ থানায়। আদালতের নির্দেশে মামলাটি পিবিআইতে আসে।

পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার উপপরিদর্শক (এসআই) ও তদন্ত কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, তিন অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তারের পর চন্দনাইশে তাঁদের গুলিতে হাবিবুর ইসলাম নামের ওই তরুণ নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেন।

আদালত ও পিবিআই সূত্র জানায়, চন্দনাইশ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রহিম উদ্দিনের পক্ষে সেদিন গ্রেপ্তার শওকতের নেতৃত্বে ৪০ জন গিয়েছিলেন। জনপ্রতি নেন ২০ হাজার টাকা করে। সেখানে সাতকানিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর লোকজন ছিলেন। অবশ্য সংঘর্ষে জড়ানো দুই প্রার্থীর কেউ-ই জিতেননি।

জানতে চাইলে চন্দনাইশ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও নির্বাচনের প্রার্থী রহিম উদ্দিন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভাড়ায় কাউকে আনিনি। সব অপপ্রচার।’

পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনে ভাড়ায় যাওয়া দলে ৩০ থেকে ৪০ জন রয়েছেন। সেখানে সাতকানিয়া, চকরিয়া, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন উপজেলার মানুষ রয়েছেন। তাঁদের দলনেতা গ্রেপ্তার শওকত। তিনি সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের মৃত মফজল আহমদের ছেলে। তাঁর বাবাও পুলিশের তালিকাভুক্ত ডাকাত ছিলেন। একসময় ঢাকায় এক আইনজীবীর মুনশি হিসেবে কাজ করলেও আট বছর আগে থেকে তা ছেড়ে দিয়ে অস্ত্র ব্যবসায় নেমে পড়েন। শওকতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মারামারির তিনটি মামলা রয়েছে।

এদিকে সাতকানিয়ায় নির্বাচনে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির পর কেন্দ্র দুটিতে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরে গত ২১ মার্চ এই কেন্দ্র দুটিতে আবার ভোট গ্রহণ করা হয়। গণনা শেষে সব কেন্দ্র মিলে চেয়ারম্যান পদে আকতার হোসেনকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। আকতার বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে আকতার দাবি করেন, ‘ভোটের দিন আমি কাউকে টাকা দিয়ে আনিনি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শওকতসহ অনেককেই এলাকার ছেলে হিসেবে চিনি।’

বাঁশখালীর জন্য অগ্রিম টাকা

পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার তিনজনকে সপ্তাহখানেক আগে বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন পিবিআইকে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের এসআই শফিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও প্রার্থীর নাম জানাতে পারেনি আসামিরা।

১৫ জুন বাঁশখালীতে গন্ডামারাসহ ১৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচনে ভাড়ায় খাটার জন্য অস্ত্রধারীদের অগ্রিম টাকা দেওয়া প্রসঙ্গে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফয়সাল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হচ্ছে।