ঢাকার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশকে পাশে চায় ভারত

  • গত এক দশকে দুই দেশের সম্পর্ক বিশেষ পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সহযোগিতা বড় ভূমিকা রেখেছে।

  • ট্রানজিট আর ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ দ্রুত সাড়া দিয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ হয়েছে।

  • বারবার প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামেনি।

  • প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তিস্তা চুক্তি সই হলো না। কবে অভিন্ন নদীর পানির চুক্তি হবে, সেটা এখনো অজানা।

তারিক এ করিম, মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান , তৌহিদ হোসেন ও মো. শহীদুল হক
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত-চীন সম্পর্ক আলোচিত হচ্ছে নানা মহলে। সেই আলোচনায় উঠে আসছে সম্পর্কের টানাপোড়েনের নানা প্রসঙ্গ।

দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক নিয়ে জল্পনার পটভূমিতে গত মাসে অনেকটা হঠাৎ করেই ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। সাধারণত এ ধরনের সফরের বিষয়ে একটু আগে জানানো হয়ে থাকে। কিন্তু এই সফরের খবর ঠিক আগের দিন দুই দেশের গণমাধ্যমের সুবাদে জানাজানি হয়। অবশ্য ১৭ আগস্ট হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ঢাকা পৌঁছানোর পরপরই ভারতীয় হাইকমিশন এক সংক্ষিপ্ত বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সম্পর্ক এগিয়ে নিতেই ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের বাংলাদেশ সফর। যদিও ওই দিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সৌজন্য সাক্ষাতের পরও বাংলাদেশের সরকারি তরফে কিছু জানানো হয়নি।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটা গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। সম্পর্কটা একটা বিশেষ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে; দুই পক্ষই এমন দাবি হরহামেশা করে যাচ্ছে। করোনার মহামারিকালে গত কয়েক মাসে দুই দেশের বেশ কটি বৈঠক ও সফর বাতিল হয়ে গেছে; এমন এক পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের হঠাৎ করে সংক্ষিপ্ত ঢাকা সফর অনেককে কৌতূহলী করে তুলেছিল। দুই দিনের এই সফরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হলেও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা। গত ১৭ আগস্ট গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনা বা সাক্ষাতের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

সোনালি অধ্যায়েও অমীমাংসিত

গত এক দশকে দুই দেশের সম্পর্ক বিশেষ পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সহযোগিতা বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে নির্মূলে বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে ভারতকে সহযোগিতা করেছে। পাশাপাশি ট্রানজিট আর ট্রান্সশিপমেন্টের বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ দ্রুত সাড়া দিয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ হয়েছে । অথচ বারবার প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামেনি। প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তিস্তা চুক্তি সই হলো না। কবে অভিন্ন নদীর পানির চুক্তি হবে, সেটা এখনো অজানা। স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকল সইয়ের পাঁচ বছর পরও মুহুরি নদীর সীমান্ত চূড়ান্ত করার বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে এত সহযোগিতার পরও রোহিঙ্গা সংকটে ভারতকে পাশে না পাওয়া বাংলাদেশকে বেদনাহত করেছে। পাশাপাশি ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে উদ্বেগ আছে।

সফরটা হুটহাট নয়

ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক নানা সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হর্ষ বর্ধন ঢাকায় আসার বেশ কয়েক দিন আগেই দুই দেশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এ নিয়ে ভারতের রাজধানীতে আলোচনা করেছিলেন। সফরের বিষয়টি নিয়ে যাতে গণমাধ্যমে জানাজানি না হয়, সে ব্যাপারে দুই পক্ষ একমত হয়েছিল। দিল্লির এক কূটনীতিক এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন যে ‘সফর নিয়ে কথা বলতে নিষেধ আছে।’

কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ১৭ আগস্ট ঢাকায় আসার অন্তত সপ্তাহখানেক আগে দুই পক্ষের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। অর্থাৎ সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথাবার্তার ফলে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় এসে দিল্লির বার্তা দিয়ে গেছেন। আবার ঢাকার বার্তা নিয়ে গেছেন দিল্লিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্যসাক্ষাৎ ও পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্কের অবস্থা সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে নানা মহলের সঙ্গে কথা বলেছেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।

সম্প্রতি ঢাকা সফরের সময় রাজধানীর একটি হোটেলে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা

পরিবর্তিত ভূরাজনীতি আর চীন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে ক্রমেই ঝুঁকছে এশিয়ার দিকে। এতে এশিয়ায় যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এমন আবহের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফরের যোগসূত্র রয়েছে।

ভারত এখন নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে। আশা করব তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, বিআইপিএসএসের সভাপতি

নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া ভারত আশা করেছিল, সেটা পায়নি। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে সংঘাতের সময় দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ভারত চিন্তিত হয়ে উঠেছে। ফলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক আছে কি না, সেটা ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ ছাড়া নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা ঠিকঠাক চলছে না। শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের ফলাফলের পর উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কটা বজায় আছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে চীনের যোগাযোগ নিয়েও ভারত চিন্তিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোতে যেভাবে চীন যুক্ত হচ্ছে, তাতে ভারতের উদ্বেগ লক্ষণীয়।

মুনীরুজ্জামানের মতে, তিস্তা ব্যারাজে চীনের ঋণের সম্ভাবনা নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। সেটা নিয়ে তারা চিন্তিত। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান একটা সমীক্ষা করেছে। চীন আভাস দিয়েছে তারা ওই প্রকল্পে অর্থায়ন ও কাজ করতে পারে।

আমরা ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। কিন্ত একতরফাভাবে কিছু হবে না। আদান-প্রদান থাকতে হবে
মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফরের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের একটা যোগসূত্র রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ধরে নিতে পারি, ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না আর আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। কাজেই এ নিয়ে ভারতের একটা উদ্বেগ থাকতেই পারে। ২০১৬ সাল থেকে আমাদের অনেক বড় প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করছে। এ নিয়ে ভারতের অস্বস্তি আছে। চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরিতার কারণে বাংলাদেশ-চীন ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কাজেই চীনের ব্যাপারে দিল্লি থেকে ঢাকায় কোনো বার্তা পৌঁছাতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব আসতে পারেন বলে একধরনের ধারণা করা যায়।’

বাংলাদেশের সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে ক্রমশ ঝুঁকছে এশিয়ার দিকে। বৈশ্বিক পটভূমিতে দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন দিক উন্মোচন করার উদ্দেশ্যে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় এসেছিলেন। একজন বন্ধু হিসেবে তাঁরা ঢাকাকে পাশে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক।

সম্পর্কের ভিন্নমাত্রা আর স্বচ্ছতা

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের বিষয়টিতে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। তবে অনুমান করে নেওয়া যায়, হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফরের সিদ্ধান্ত এক দিন আগে হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কোন কোন বিষয়ে কথা হয়েছে, তা–ও এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। তথ্য যদি পাওয়া না যায়, তখন জল্পনার ডালপালা গজাতে শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়াতে থাকে। বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্কের স্বার্থে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ না দেওয়া ভালো। বিস্তারিতভাবে জনসাধারণকে জানাতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। অন্ততপক্ষে একটা বিবৃতি এলে ভালো হতো। কারণ, সম্পর্কটা অনেক বেশি বহুমাত্রিক। তাই মানুষ জানতে চায় আসলেই কী নিয়ে কথা হয়েছে।’

অবশ্য সফরের স্বচ্ছতা নিয়ে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার ও ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গোপসাগরীয় ইনস্টিটিউট প্রকল্পের জ্যেষ্ঠ ফেলো তারিক এ করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের সফরের মধ্য দিয়ে দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা হয়ে থাকে। কূটনীতিতে অনেক সময় জনসমক্ষে থেকে অনেক কিছু করার সীমাবদ্ধতা থাকে। হঠাৎ করে কোনো বিষয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে সেটার সুরাহা তো সেভাবেই করতে হবে। কূটনীতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল বেশির ভাগ দর–কষাকষি কিন্তু সব সময় নেপথ্যেই হয়েছে, প্রকাশ্যে নয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে আসার পর হয়তো জনগণ তা জানতে পেরেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।

দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক যখন এত বহুমাত্রিক এবং অন্য কোনো সম্পর্কের সঙ্গে তুলনীয় নয়, সেখানে জনগণের স্বার্থে স্বচ্ছতা বাঞ্ছনীয়
মো. শহীদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

অবশ্য সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকও মনে করেন দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক যখন এত বহুমাত্রিক এবং অন্য কোনো সম্পর্কের সঙ্গে তুলনীয় নয়, সেখানে জনগণের স্বার্থে স্বচ্ছতা বাঞ্ছনীয়। তিনি বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক এখন এমন একটা স্তরে পৌঁছে গেছে, সেখানে সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র বাড়ছে। তাই সম্পর্কের স্বার্থেই স্বচ্ছ অবস্থান থাকলে ভালো হয়। তাঁর মতে, দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটিকে কোনো সাধারণ সংজ্ঞায় ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটাকে অন্য কোনো সম্পর্কের সঙ্গে প্রতিস্থাপিত করা যাবে না। ২০১৯ সালে বলাই হয়েছিল, এই সম্পর্ক কৌশলগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। এ ছাড়া দুই দেশের জনগণের যোগাযোগ কয়েক শতকের।

উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা আর ভারতের দায়

কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও বেশ কিছু বিষয়ে ভারত সরকারের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বাংলাদেশের উদ্বেগ দূর করার বিষয়ে ভারত তেমন সংবেদনশীল নয়। আবার বাংলাদেশ নিজের স্বার্থে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলে তাতে ভারতের প্রতিক্রিয়াটা বিস্মিত করার মতো।

বাংলাদেশের সুবিধাটা হচ্ছে ভারত ও চীন দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কটা বেশ ভালো। এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমাদেরকে সেতু হিসেবে রেখেছে
তারিক এ করিম, ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার

মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের নিরীখে রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের কাছ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, সেটা পাইনি। সারা বিশ্ব যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে গণহত্যার জন্য দোষারোপ করেছে, তখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন। ভারত এখন নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে। আশা করব তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে।’
ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার তারিক করিম বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কের মাত্রা ঠিক করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনিই বলেছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তেমনি আমরা চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক করার চেষ্টা করছি। বারবার আমরা ভারতকে বলেছি, চীনের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, সেটা তোমাদের বিরুদ্ধে নয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্কটা চলতে থাকবে। তোমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সুবিধাটা হচ্ছে, ভারত ও চীন দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কটা বেশ ভালো। এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমাদের সেতু হিসেবে রেখেছে। আমরা একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনকে বেছে নেব না। আমরা বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) বাদ দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিকে যাব না। জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েই আমাদের টিকে থাকতে হবে।’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের স্বার্থেই চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। এটা না করে বাংলাদেশের কোনো উপায় নেই। কাজেই বন্ধুদেশ হিসেবে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নিয়ে ভারতের অস্বস্তি বোধ করাটা উচিত নয়। বাংলাদেশ যদি উন্নতি লাভ করে ভারতের জন্য ভালো। ভারতের বাজার বড় হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুবিধা হবে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু যদি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, সচ্ছল থাকে, সেটা আপনার জন্য সব সময় সুবিধাজনক। ভারতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও বড় হলে, উন্নত হলে, এমন সুযোগ ভারতের জন্য আরও বাড়বে।

তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পৃথিবীর একমাত্র সীমান্ত এলাকা, যেখানে শান্তির সময়ে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শত্রুদেশ নয়, যুদ্ধ চলছে না; অথচ গুলি করে মানুষ মারা হয়, এটা হতে পারে না। যে অজুহাতই ভারত দিক না কেন, শক্ত সিদ্ধান্ত যদি রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের থাকে, তাহলে এটা হওয়ার কথা নয়। ভারত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তো করছেই, সেই সঙ্গে তাদের উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদেরা যেসব মন্তব্য করেছেন, তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। এতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা অপমানসূচক কথা বলার কোনো অধিকার ভারতের নেই। যত তাড়াতাড়ি ভারতের রাজনীতিবিদেরা এটা বুঝবেন, ততই মঙ্গল। আমরা ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। আদান-প্রদান থাকতে হবে।’