ভালো ইসি গঠিত হবে—এই বিশ্বাস তৈরি হওয়া দরকার

ইউপি নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

আইনের মাধ্যমে একটি ভালো নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হচ্ছে বা হওয়া সম্ভব, রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি হওয়াটা জরুরি। এ জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন আইনে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে। নাগরিকদের আস্থা অর্জনের জন্য দরকার ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে মানুষের জানার সুযোগ করে দিতে হবে। এর জন্য নির্বাচন কমিশন গঠনে তড়িঘড়ি না করে ৪-৫ মাস সময় নেওয়া উচিত।

‘প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন: জন-আকাঙ্ক্ষা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তাদের কাছ থেকে মোটাদাগে এসব মতামতই উঠে এসেছে। এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এবং সিটিজেনস ফর গুড গভর্ন্যান্স। বক্তারা ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। এর মধ্যে সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা, সাবেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জ্যেষ্ঠ পরিচালক আবদুল আলিম প্রমুখ বক্তৃতা করেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। আর সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান।

আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন ইসি গঠনে সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে বিলটির ওপর সংসদীয় কমিটি মতামত দিয়েছে। পাসের জন্য জাতীয় সংসদে তোলা হবে। এই পরিস্থিতিতে এই গোলটেবিল বৈঠক কতটা আমলে নেবে সরকার, এই প্রশ্ন উঠেছে। অধিকাংশ বক্তাই সংশয় প্রকাশ করেছেন যে তাঁদের মতামত আইন প্রণয়নে আমলে নেওয়া হবে না। তবে ভবিষ্যতে আইনটির সংশোধনের প্রয়োজনে এই পরামর্শগুলো কাজে আসতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে, যাঁর কোনো দাগ নেই

সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, আইনের প্রতিটি স্তরেই যদি অবিশ্বাস থাকে, তাহলে তো আইন করে খুব বেশি সুবিধা হবে না। আর আইন বড় হলেই যে ভালো হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইসি গঠনের আইন ছোটই হওয়া দরকার। তবে আইনটির সঠিকভাবে প্রয়োগ হবে, এই বিশ্বাস রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে তৈরি করতে হবে।

এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘আইনের খসড়ায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে এবং আইনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারের অধীন এবং রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত।’ তিনি মনে করেন, বিদায়ী সিইসিকেও সার্চ কমিটিতে রাখা যায়। কারণ, তাঁর আর ইসিতে ফিরে আসার সুযোগ নেই। বিদায়ী সিইসি নোংরা রাজনীতিতে জড়িত নন এবং বিদ্যাবুদ্ধি আছে ধরে নিয়েই এই মত দিয়েছেন বলে তিনি জানান।

সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়ে আরও কঠোর হওয়ার মত দেন সাবেক সিইসি শামসুল হুদা। তিনি বলেন, কোনো ধরনের লিখিত-অলিখিত অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁদের বিবেচনাতেই নেওয়া ঠিক হবে না। এখানে তিন-চারটি পদ। এর জন্য দেশে ভালো মানুষের অভাব হবে না। একটি ভালো কমিশন করতে হলে কোনো দাগ লাগা লোক আনা যাবে না। তিনি আরও বলেন, ইসি এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে, যাঁর পুরো জীবনে কোনো দাগ নেই। অভিযোগ এসেছিল, আবার ছাড়াও পেয়েছেন, এমন লোক ইসিতে আনতে হবে কেন?

নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের নিরপেক্ষতা দেখতে হবে

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসি গঠনে প্রথমেই দেখতে হবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের নিরপেক্ষতা দৃশ্যমান। আর দেখতে হবে, তাঁদের আইন প্রয়োগের সক্ষমতা আছে কি না? নির্বাচনে ১০০ মানুষ মারা গেল, আর বলা হলো ‘আমার কিছু করার নেই!’ তাহলে তো কোনো লাভ নেই। দায়িত্ব ইসিকে নিতে হবে।
ইসি গঠনে সংসদ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করার পরামর্শ দেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, সংবিধানমতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিছু করতে পারেন না। ফলে সার্চ কমিটির বাছাই করা নাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেই। যদি সার্চ কমিটির বাছাই করা নাম সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানো হয়, সেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা ও অন্য বড় দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এতে আরও লাভ আছে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রীর মত সংসদীয় কমিটিতেই চলে আসবে। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে সার্চ কমিটির বাছাই করা নামগুলো বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়বে। মানুষ ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে পারবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির সুযোগ হবে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন কমিশন হয়েছে, কোনোটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়

বাছাই করা নামগুলো প্রকাশ দরকার

ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের আবদুল আলিম আশপাশের দেশগুলোতে কীভাবে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, এর উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি নিয়োগ করা হয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাছাই করা নামগুলো প্রকাশ করে দেওয়ার মত দেন তিনি। যাতে মানুষ মতামত দিতে পারে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ৪-৫ মাস সময় নেওয়ার কথা বলেন তিনি।

নির্বাচনকালীন সরকার পরিবর্তন

অধ্যাপক আসিফ নজরুল মনে করেন শুধু নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের সময় সরকারের ধরনটা কেমন হয়, এর ওপর সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে। যত ভালো আইনই হোক না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের মৌলিক পরিবর্তন লাগবেই।

ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্বচ্ছতা

এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চালক রওনক জাহান বলেন, ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বচ্ছতা। এটা না থাকলে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য আসবে না। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর রিপাবলিকান পার্টির অ্যাটর্নিদের ভোটের ফলাফল নির্ণয়ে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। কারণ, তাঁরা মনে করেছেন, আইনে তো এটা নেই। ফলে এই ধরনের একটি আইন এবং সংস্কৃতি থাকা জরুরি।

সুজনের সুপারিশ

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার তাঁর মূল প্রবন্ধে সরকারের করা আইনের খসড়া, সুজনের দেওয়া খসড়া এবং এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসির করা খসড়ার একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখান যে ২০১৭ সালে সার্চ কমিটি গঠনের যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, এর সঙ্গে প্রায় মিলে যায় সরকারের করা খসড়াটি। আইন দিয়ে অনুসন্ধানের কোনো সুযোগ নেই। স্বচ্ছতা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, সরকারের সুবিধাভোগী এবং নিজেদের লোক দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন হবে। চাইলে বর্তমান সিইসি কে এম নূরুল হুদার মতো লোক নিয়োগ পেয়ে যেতে পারেন।

বদিউল আলম মজুমদার মূল প্রবন্ধে ইসি গঠনের আইন নিয়ে সুজনের সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে সংসদের সরকারি দল, প্রধান বিরোধী দল এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন করে সার্চ কমিটিতে রাখতে হবে। সার্চ কমিটির করা নামের তালিকা প্রকাশ করে দিতে হবে। রাজনৈতিক সংশ্লেষ নেই, এমন লোক নিয়োগ করতে হবে ইসিতে।