খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ বাহারুল আলমকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় বাহারুলের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। একই কারণে বাহারুলকে কেন দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, সাত দিনের মধ্যে এর কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আবরার বুয়েটের শেরেবাংলা হলে থাকতেন। গত রোববার রাতে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী।
৯ অক্টোবর খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ফরিদ আহমেদের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় বাহারুলকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার ও কারণ দর্শাতে বলার বিষয়টি জানানো হয়।
ফরিদ আহমেদের পাঠানো বার্তায় বলা হয়, ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সভা হয়। সভায় দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ, সরকারপ্রধান, দলীয়প্রধান ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য ফেসবুকে প্রদান এবং ৭ অক্টোবর দৈনিক সময়ের খবর পত্রিকায় তা প্রকাশিত হওয়ায় খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ডা. শেখ বাহারুল আলমকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কেন তাঁকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ করা হবে না, আগামী ৭ দিনের ভেতরে এ বিষয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
বাহারুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজ বা চিঠি পাইনি। তবে দল সম্পর্কে কোনো কথাই আমি আমার স্ট্যাটাসে লিখিনি। আমি যেটুকু লিখেছি, তা হলো ভারত যে সব বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করছে, সেটা আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সমালোচনা করেছি। এখানে প্রধানমন্ত্রী না, এখানে কোনো চুক্তি না, আওয়ামী লীগ বা দল সম্পর্কে আমার স্ট্যাটাসে কোনো শব্দ নেই। তাহলে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ কীভাবে হবে?’
বাহারুল বিএমএ খুলনা শাখার সভাপতি। গত ৬ অক্টোবর তিনি তাঁর ফেসবুকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসটির শিরোনাম: ‘ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বলা হলেও বাস্তবে একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত-বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ ও অধিকার চরম উপেক্ষিত’।
বাহারুলের স্ট্যাটাস
‘দুর্বল অবস্থানে থেকে বন্ধু-প্রতিম শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বৈঠকে-ফলাফল শক্তিধরের পক্ষেই আসে। বাংলাদেশ-ভারত উভয়-পক্ষীয় সমঝোতা স্মারক নাম দেওয়া হলেও বাস্তবে একপক্ষীয় সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হয় দুর্বল রাষ্ট্রকে।
ভারত বাংলাদেশ থেকে তার সকল স্বার্থই আদায় করে নিয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে এখনো ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি।
১. দীর্ঘদিনের আলোচিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন এবারের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় স্থান পায়নি।
২. ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে কিছু না বললেও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হুংকার দিয়েছে নাগরিক পঞ্জীতে বাদ পড়া জনগণকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হবে। তারপরেও এবারের সমঝোতা চুক্তিতে ‘অভ্যন্তরীণ’ অজুহাতে বিষয়টি স্থান পায়নি।
৩. বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ভারত কিছু বলেনি।
৪. তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চুপ থাকলেও বাংলাদেশ অংশের ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরা রাজ্যের পানীয় জল হিসাবে প্রতিদিন ১.৮২ কিউসেক টেনে নেবে ভারত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে।
৫. বাংলাদেশের জনগণের তরল গ্যাসের চাহিদা পূরণের ঘাটতি থাকলেও ভারতে তরল গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং যৌথভাবে সে প্রকল্প উদ্বোধনও হয়েছে।
৬. চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারত কীভাবে ব্যবহার করবে, তা নির্ধারিত হলেও বাংলাদেশের জন্য ব্যবহারযোগ্য ভারতের কোনো বন্দর সেই তালিকায় ছিল না।
অমানবিক আচরণের শিকার হয়েও বাংলাদেশ পানি ও গ্যাস সরবরাহ দিয়ে মানবিকতার প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ ও অধিকার উপেক্ষিত রেখে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষ হয়েছে।
শক্তিধর প্রতিবেশীর আধিপত্যের চাপ এতই তীব্র যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে কিনা আশঙ্কা হয়। কারণ ভারতের চাপিয়ে দেওয়া সকল সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে মেনে নিতে হচ্ছে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাহারুলের ভাষ্য, তাঁর বক্তব্য নেওয়ার আগেই দল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের কোন ধারা, কোন বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। দীর্ঘদিনের উপদলীয় কোন্দল ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাহারুল বলেন, ‘আমি মনে করি, নাগরিক হিসেবে, আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি আমার দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখতে চাইব। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী-সমর্থক হিসেবে আমি আমেরিকা, মিয়ানমার বা ভারতের সমালোচনা করতে পারব না?’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাহারুল সমালোচনা করেছেন। দেশের কেউ রিঅ্যাক্ট করলেন না, উনি (বাহারুল) কেন করলেন? উনার কোনো বক্তব্য থাকলে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারতেন। তাঁর ব্যাপারে নেওয়া ব্যবস্থা আমার একার ব্যাপার না। জেলা আওয়ামী লীগের জরুরি সভায় উপস্থিত থাকা ১৬ জনের সবার সিদ্ধান্ত।’