ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কি দেশের পুলিশ বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী? সোমবার ভোরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর এ প্রশ্নই ঘুরেফিরে এসেছে। ওই দিন আবরারকে মারধরের খবর পেয়ে চকবাজার থানা-পুলিশের একটি দল শেরেবাংলা হলে গেলেও ছাত্রলীগ নেতারা পুলিশকে ভেতরে ঢুকতে দেননি।
হলের ভেতরে একজন নিরীহ ছাত্রকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে আর তাঁকে উদ্ধারে অনুমতির জন্য বাইরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে পুলিশকে। বুধবার এ নিয়ে প্রথম আলোয় খবর প্রকাশের পর পুলিশের অনেক কর্মকর্তা তাঁদের ক্ষোভের কথা বলেছেন, বলেছেন অসহায়ত্বের কথাও। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের গাঁটছড়া সম্পর্ক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আবার সোমবার সকালেই আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বিক্ষোভ শুরু হলে পুলিশ ঠিকই তৎপর হয়, দ্রুতগতিতে আসামিদেরও গ্রেপ্তার করে। তাহলে কি পুলিশ অন্য কারও সংকেতের অপেক্ষায় থাকে? নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না? এই প্রশ্নও এখন দেখা দিয়েছে।
পুলিশের সাবেক আইজি এনামুল হক বলেন, যেকোনো স্থানে গন্ডগোলের খবর পুলিশের নজরে আসার পর আইনে পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেই ক্ষমতা নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করবে। এটাই পুলিশের কাজ।
দেশের পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। বড় বড় অনেক অপরাধ দমনে সফলতা দেখিয়েছে পুলিশ, বিশেষ করে জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে তাদের সাফল্য উদাহরণ হিসেবে দেখা যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে অনেক প্রশ্ন থাকলেও সাফল্য দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সফলতার পরও অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে পেশাদারির ঘাটতি থাকার অভিযোগ আছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে পুলিশ। আবার একে অন্যের হয়ে কাজ করতেও দেখা গেছে। বিএনপি আমলেও ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে পুলিশের সখ্য কম ছিল না।
আবরার ফাহাদ খুন হওয়ার পর অনেক নামের সঙ্গে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যার প্রসঙ্গটিও নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকায় দরজি বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা। বিএনপির ডাকা অবরোধের মধ্যে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে দায়িত্বরত পুলিশের সামনেই। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সেদিনের তাণ্ডবের সামনে পুলিশ ছিল নীরব, দর্শকের ভূমিকায়।
এক বছর আগের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনও আরেকটি বড় উদাহরণ। ওই সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় ছাত্রলীগ হামলা চালায়। সারা দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই হামলার শিকার হন। গত বছরের জুলাইয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। তরিকুলের ওপর হামলাকারীদের ছবি, ভিডিও এবং তাঁর ভাঙা পায়ের এক্স-রে রিপোর্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে হামলাকারী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মী শনাক্ত হন। একই আন্দোলনের সময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের হামলায় আহত ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে ছাত্রলীগের নেতারাই পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সরকার ১১ বছর ধরে ক্ষমতায়। সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাঁরা এখন মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে। তাঁদের অনেকেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলেন। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিলেও তাঁদের অনেকেই নিজেদের দলের বাইরে ভাবতে পারেন না। নিজের কর্মক্ষেত্রে থেকেও দলের প্রতি অনুগত থাকেন। তাঁরাই সরকার ও সরকারি দলকে একাকার করে দিয়ে নিজের সুবিধা আদায় করেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন, একই জায়গায় বছরের পর বছর ধরেও থেকে যান। অন্যদিকে যাঁরা দক্ষ ও পেশাদার, তাঁরা থাকেন কোণঠাসা হয়ে।
সাবেক আইজিপি আজিজুল হক এসব নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আগে পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বেশ দূরত্ব ছিল। এখন সে দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে। এটা হয়তো পরিস্থিতির কারণে হচ্ছে। তবে দূরত্ব যা-ই হোক না কেন, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেটা নিরপেক্ষ হতেই হবে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
গত বছরের জুলাই মাসে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে, সে সময়ও ছাত্রলীগের সহযোগীর ভূমিকায় দেখা যায় পুলিশকে। ১ আগস্ট আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বোঝাতে ছাত্রলীগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর এক দিন পরই হেলমেট পরে লাঠিসোঁটা হাতে ছাত্রলীগ রাস্তায় নামে। আর তাদের পাহারায় ছিল পুলিশ বাহিনী। ওই সময় হামলাকারীদের পরিচয় শনাক্ত করে বিস্তারিত তথ্য প্রথম আলোকে প্রকাশিত হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ প্রশাসন। ৬ আগস্ট পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশি পাহারায় শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের বেদম পেটায় ছাত্রলীগ। এর রেশ থেকে যায় পরেও। গুজব ছড়ানোর অভিযোগ তুলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী লুৎফুন্নাহার সরকার ওরফে লুমা সরকারকে বাড়ি থেকে তুলে এনে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করে পুলিশ। ফেসবুকে সরকারবিরোধী পোস্ট দেওয়ায় শামসুন্নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রাতের বেলা ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখে। এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আন্দোলন দমনে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের উপস্থিতি প্রসঙ্গে ১০ আগস্ট পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারীকে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। প্রশ্নটি ছিল, পুলিশ কি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। জবাবে আইজি বলেছিলেন, বাংলাদেশ পুলিশ স্বয়ংসম্পূর্ণ।
তারপরও একই ধরনের কাজে জড়িত থাকতে দেখা গেছে পুলিশ বাহিনীকে। সর্বশেষ আবরার ফাহাদ হত্যার রাতে দেখা গেল, ছাত্রলীগের অনুমতির জন্য পুলিশ হলের গেটে অপেক্ষা করেছে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ হাদিস উদ্দিন সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের চোখে সবাই জনগণ। সেখানে কাউকে দল হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এভাবে দেখলেই সেটা একপেশে পুলিশিং হবে, এখন যা হচ্ছে। এটা তো মূল কাজ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এ ধরনের পুলিশিং কারও জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না।
আবরার হত্যার ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সাতজন সাবেক পুলিশপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁদের মধ্যে তিনজন কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি তাঁদের নাম ও পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। পুলিশের বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বলেছেন, বেতন-ভাতা বহু গুণ বাড়ানোর কারণে সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকর্ষণ আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ বাহিনীতে অনেক দক্ষ কর্মকর্তাও আছেন। দায়িত্ব দিলে দক্ষতার প্রমাণও পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারি দলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় সব দক্ষতাই চাপা পড়ে যায়। অন্যদিকে গত সাধারণ নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে পুলিশ বাহিনী, শেষ পর্যন্ত তাতে বিপাকে পড়ে সরকার, ক্ষতি হয় দেশের। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি যতটা দ্রুত বুঝবেন, ততটাই মঙ্গলজনক।