কথা ছিল লন্ডন সফররত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যপ্রবাসীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। কিন্তু নেতা-কর্মীদের হই হুল্লোড় আর ধাক্কাধাক্কির কারণে তিনি শুভেচ্ছা পর্ব না সেরেই বক্তব্য দিয়ে বিদায় নেন। বক্তব্যে খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারের কড়া সমালোচনা করেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে ঈদুল আজহা পালিত হয়। পূর্ব লন্ডনের বার্কিংসাইড এলাকার ‘দ্য লেকভিউ’ মিলনায়তনে এদিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের আয়োজন করে বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখা। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছেলে তারেক রহমান ও তারেকের স্ত্রী জোবায়দা রহমানকে নিয়ে খালেদা জিয়া মঞ্চে হাজির হন। শুরু হয় ছবি তোলার জন্য নেতা-কর্মীদের হুড়োহুড়ি। নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে দফায় দফায় ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। শেষমেশ চরম হট্টগোলের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু করা হলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে মিনিট দশেকের মধ্যে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে বক্তব্যের শুরুতেই খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের যুক্তরাজ্যের সভ্য পরিবেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তারা যেন শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনটুকু বোঝেন। তিনি প্রায় ২৫ মিনিট বক্তব্য দেন।
শেখ হাসিনা সরকারের কড়া সমালোচনা করে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, দেশে বর্তমানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, আইনের শাসন কিংবা গণতন্ত্র কোনোটাই নেই। আদালতগুলোতে আওয়ামী লীগের লোক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাক্ষী প্রমাণ যাই থাকুক আওয়ামী লীগ যা বলছে সেটাই বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
বিরোধী দলগুলোকে এখন মানববন্ধন, মৌন মিছিল, সমাবেশ এমনকি হলের ভেতরেও কোনো সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘পুলিশ নিজেরাই বলে যে তারা এই সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। কাজেই এটা পুলিশ স্টেট হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক সরকার নেই, পুলিশ স্টেট। পুলিশরা এখন যা ইচ্ছা তাই করছে’। আওয়ামী লীগের যারা পুরোনো জ্যেষ্ঠ নেতা-কর্মী তাঁরাও পাত্তা পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন খালেদা জিয়া।
খালেদা উপস্থিত নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন করে বলেন, ‘আপনাদের মনে আছে বাকশাল? সেই বাকশালের মতো অবস্থা করে ফেলেছে দেশে’। তিনি বলেন, ‘দেশে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ নিরাপদ নয়। এই অবস্থা আগে কখনো ছিল না। হাসিনার এগেইনস্টে কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। হাসিনা যে মিথ্যা কথা বলছে, অন্যায় করছে তার জবাবও কেউ দিতে পারবে না। বাংলাদেশ এখন কঠিন সময় পার করছে। জনগণ এই সরকার থেকে মুক্তি চায়’।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, দেশে সংবাদপত্রের কোনো স্বাধীনতা নেই। সাংবাদিকেরা কিছু লিখলে পরের দিন তাঁদের নামে মামলা হয়ে যায়। যারা সরকারের বেআইনি কাজের সঠিক সমালোচনা করেন তাঁদের এখন আর টকশোগুলোতে যেতে দেওয়া হয় না। সামাজিক কিংবা মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশের অবস্থা নিয়ে কথা বললে তাদের ওপরও সরকার চড়াও হচ্ছে বলে প্রবাসীদের জানান খালেদা জিয়া।
বর্তমান সরকার পুরো দেশটাকে একটা কারাগারে পরিণত করে ফেলেছে মন্তব্য করে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, বিএনপির যত নেতা-কর্মী আছে সকলের নামে মামলা। জেলখানায় জায়গার অভাবে মানুষ ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছে না।
সরকার গায়ের জোরে টিকে আছে উল্লেখ করে খালেদা বলেন, আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধানকে নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হাসিনা গদি ছাড়বেন না। কারণ তারা এত চুরি, লুটপাট, দুর্নীতি করেছে যে তারা পার পাবেন না’।
কারও নাম উল্লেখ না করেই খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে কিছু পরগাছাও বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছে। যারা কোনো নির্বাচনে জামানতও রক্ষা করতে পারে নাই।
খালেদা জিয়া দাবি করেন, জনগণ বিএনপির পেছনে ঐক্যবদ্ধ। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপিরই জয় হবে। আওয়ামী লীগ এ কারণে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে চায় না। তিনি বলেন, বর্তমান এক দলীয় পার্লামেন্টের বিতর্ক করার কিছু নেই। শুধু খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, জিয়াউর রহমানকে গালাগাল আর মিথ্যা কথা বলাই তাদের কাজ।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেন, সরকার উন্নয়নের কথা বললেও উন্নয়ন কোথাও নাই। ঢাকার রাস্তাঘাট দিয়ে চলা যায় না। হাইওয়েগুলোর অবস্থা একই। বড় বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়ে কেবল অর্থ আত্মসাতের বন্দোবস্ত হচ্ছে।
ক্ষমতায় গেলে দেশে যুক্তরাজ্যের মতো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছার কথা জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, তারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ঐক্যের রাজনীতি করতে চান উল্লেখ করে খালেদা বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল। তাদের মধ্যেও ভালো লোক আছে এবং তারাও দেশকে ভালোবাসে।
যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর আহমদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত ওই ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তারেক রহমান এবং আমির খসরু মাহমুদও বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আব্দুল আউয়াল মিন্টু, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ফুলের তোড়া নিয়ে খালেদাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসা অনেকেই নিরাশ হয়ে ফিরে গেছেন। আমিনুর রহমান আকরাম নামে একজন এসেছিলেন জিয়া পরিবারের ছবি বাঁধাই করা একটি ফ্রেম নিয়ে। মঞ্চে উঠতে না পারায় ক্ষুব্ধ আকরাম অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ওপর দোষ চাপান।