একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একচেটিয়া ভোটে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ, ২৫৭টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়েছে এই জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি, ২২টি। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে মাত্র ৮টি আসন। এর মধ্যে বিএনপি এককভাবে পেয়েছে ৬টি। যদিও বিএনপি জোটের নির্বাচিতরা এখনো সাংসদ হিসেবে শপথ নেননি। অর্থাৎ, এই হিসাবে, প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দুটি দলই মহাজোটের। আর এতেই বেঁধেছে গোল। সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কে হবে সেই সিদ্ধান্তও নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।
বিএনপি জোটের নির্বাচিত শপথ না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় পুরো সংসদ হয়ে পড়ছে অনেকটাই একপেশে। কেননা এখন পর্যন্ত একাদশ সংসদে সব দলই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের। আর তাই বিরোধী দলে শরিক জাতীয় পার্টিকে পাঠিয়ে পুরো স্বস্তি পাচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তাই এখন সংসদে বিরোধী পক্ষকে আরও শক্তিশালী করতে জাতীয় পার্টির মতো অন্য শরিক দলের সাংসদদের বিরোধী আসনে বসাতে চাইছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে তাদের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী ১৪-দলের শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া), জেপি, তরিকত ফেডারেশনকেও বিরোধী দলে ঠেলে দিতে চাইছে আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে শরিক দল থেকে কাউকে মন্ত্রী করা হয়নি। এ ছাড়া মহাজোটের আরেক শরিক বিকল্পধারা বাংলাদেশও থাকছে বিরোধী দলে। অথচ জাতীয় পার্টি বাদে অন্য শরিকদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। এখন নৌকার মাঝিরাই চাইছেন তাঁরা দলের আসনে বসুন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দল শক্তিশালী না হলে সংসদ কার্যকর কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি না আসায় সে সময় জাতীয় পার্টি সরকারে ও বিরোধী দলে থেকেছে। এ নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে। এবার বিএনপি বেশি আসন পায়নি। ফলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি হতে চাইলে সে ক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘এ কারণে অন্য দলগুলোকে বিরোধী দলে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যেন সংসদ জমজমাট থাকে। কোনো সিদ্ধান্ত যেন বিনা চ্যালেঞ্জে সরকার করতে না পারে।’
বর্তমান সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক মনে করেন বিএনপি সংসদে আসবে। তিনি বলেছেন, বিএনপি বেশি আসন পায়নি, নিজেদের কারণেই। তারপরও তাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্য সংসদে আসলে নিঃসন্দেহে সংসদে তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারবেন। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যদি বিএনপি সংসদে না যায়, তাহলে জনগণই দেখবে তাদের কী পরিণতি হয়। আমার এ বিষয়ে বলার কিছু নেই।’
একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হয়েছে এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। আর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা এইচ এম এরশাদ। অথচ এরশাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে জিতেছে। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে এর আগে অনেকেই ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। এখন ১৪ দলীয় জোটের শরিকেরা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি জোটের নির্বাচিতরা সংসদে আসলে পরিস্থিতি অন্য রকম হবে। তখন আর সংসদ নিয়ে অস্বস্তি থাকবে না।
জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার বিষয়টি ‘নির্ধারিত’ হয়েছিল সরকার প্রধানের ইচ্ছাতেই। আবার এখন ১৪ দলের শরিকেরা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে, সেটিও আলোচনায় এনেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। যদিও তাঁর আগে ১৪ দলের বেশ কয়েকজন নেতা বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন।
এবার নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ভোটে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
ফলে ভোটে আওয়ামী লীগ ও এর শরিকদের একচেটিয়ার জয়ের পরই আলোচনা ওঠে, একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে কে? কারণ বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এই সংসদ অর্থহীন। এত বড় ভোট ডাকাতি করে একটা সরকার, একটা সংসদ করা হয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগ ঠিক করছে কে সরকারে থাকবে আর কে বিরোধী দলে থাকবে। এর কোনো মানে হয় না। জনগণ সবই বোঝে, তারাই এর জবাব দেবে।
অন্যদিকে জাপা সরকারের জোটসঙ্গী। এ অবস্থায় ৩ জানুয়ারি নবনির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন জাপা নেতারা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাপার কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘কে বিরোধী দলে হবে, সেটা সরকার দেখবে। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের সময় চেয়েছি আমরা।’
জাপার বৈঠকের একদিন পর ৪ জানুয়ারি দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হবে। বিরোধী দলীয় নেতা হবেন এরশাদ নিজেই। তবে আগের মতো তাঁর দলের কোনো সদস্য মন্ত্রী হবেন না।
আর বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ১৪ দলের শরিকেরা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করলে তাঁদের জন্য ভালো এবং সরকারের জন্যও ভালো।
আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪ দলের শরিকেরা বিরোধী দলে থাকলে জাপা হবে সংসদে প্রধান বিরোধী দল। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টহীন জাতীয় সংসদ এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা চিন্তা করে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ‘শুভেচ্ছা বিনিময়ে’র চিন্তা করেছেন। সবার পরামর্শে দেশ চালানোর চিন্তা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো শেষে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন নির্বাচন বাস্তবে সম্ভব নয়। এখন বাস্তবতা মেনে নিয়ে সবাই যেন সহায়তা করেন। আমাদের দিক থেকে আমরা পাঁচজন উপদেষ্টা, সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যাঁরা আছেন, সবাই সবার সহায়তা চাই। প্রধানমন্ত্রী বললে আমরা অন্যদের সঙ্গে কথাও বলব। আপনারা আসুন, বাংলাদেশ তো সবার, দেশকে গড়ে তুলি।’
সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ‘শুভেচ্ছা বিনিময়’ কিংবা ‘সংলাপ’, যেটিই হোক না কেন, এখন সংসদে বিরোধী দলের বিষয়টি মূল আলোচনার বিষয়। এর অন্যতম কারণ হলো, গত ১০ বছরে বিএনপির দাপটহীন রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ১৪ দলীয় জোট বা মহাজোটের শরিক দলগুলো। যে কারণে গত দুই মেয়াদে জোটের প্রভাবশালী নেতাদের মন্ত্রিত্বও দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এবার নবগঠিত মন্ত্রিসভায় সেই সুযোগটিও হারিয়েছেন শরিক দলগুলোর নেতারা।
মূলত নিজেদের জোটের বড় জয়ের কারণেই জোটের সরকার না করে এখন সেখান থেকে শরিক দলগুলোকে দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দল তৈরি করতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: