জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটকে চাপে রাখতে ত্রিমুখী পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। তা হচ্ছে, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত মাঠ দখলে রাখতে দল ও জোটগতভাবে টানা কর্মসূচিতে থাকা। বিএনপি, ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টকে বিতর্কিত করতে বেছে বেছে নেতাদের সমালোচনা করা। বিরোধী দল মাঠে নামার চেষ্টা করলেই শক্ত হাতে দমন; আর তাদের কেউ সরকারের ছক মেনে নির্বাচনে এলে সুবিধামতো কিছু ছাড়-সমঝোতা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকে মনে করছেন, বিএনপি বুঝে গেছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারসহ তাদের অন্য দাবিগুলো বাস্তবায়ন হবে না। তফসিল ঘোষণার মাসখানেক বাকি। এর মধ্যে ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের দিন ধার্য আছে। এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাজা হতে পারে। এই অবস্থায় অল্প সময়ের মধ্যে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অথবা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। কেউ নির্বাচনে আসার আগ্রহ দেখাবে, কেউ বর্জনের ঘোষণা দিয়ে প্রতিহত করতে চাইতে পারে। এই ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী অংশকে দিয়ে দল বা জোট ভাঙার চেষ্টা থাকবে এবং তাতে সফল হলে তাদের সঙ্গে আসন সমঝোতাসহ প্রয়োজনীয় সবই করবে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিরোধীদের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী অংশটা মনে করছে, সরকার শেষ পর্যন্ত কিছুটা হলেও ছাড় দেবে। তবে তারা এখনো দ্বিধাগ্রস্ত। অন্য অংশ মনে করছে, আওয়ামী লীগের ছক মেনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অর্থ বিরোধী দলের আসনে বসা এবং নির্বাচনের বৈধতা দেওয়া। তবে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, কোনো কারণে বিএনপির কট্টর অংশ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে তাদের ঘায়েল করা কঠিন হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি এবার নির্বাচন বর্জন করলে দলের ভেতরেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হবে। তারা সেই পথে হাঁটবে না বলে মনে হয়। আর বিএনপি জোট ২০১৪ সালে নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি। আগামী নির্বাচনেও পারবে না। সরকার, আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের সেই প্রস্তুতি আছে। তিনি জানান, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল সভা-সমাবেশ কর্মসূচি নিয়ে মাঠ দখলে রাখবে। তফসিল ঘোষণার পর প্রচার কৌশলে পরিবর্তন আসবে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত গণসংযোগ ও সভা-সমাবেশের টানা কর্মসূচি পালন করবে। এর বড় লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধীদের চাপে রাখা, নিজেদের নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখা এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের প্রচার করা। এসব সভা-সমাবেশ থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং ড. কামাল হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ
ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করা হবে।
বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বৃহত্তর যে ঐক্য প্রক্রিয়ার চেষ্টা চলছে, তাতে সম্প্রতি রাজনীতিতে একটা চাঞ্চল্য এসেছে। যদিও সরকারি দলের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, তাদের বিশ্বাস, এই ঐক্য প্রক্রিয়া বেশি এগোতে পারবে না। তারপরও বিষয়টি হালকাভাবে নিচ্ছে না। যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা এবং তাদের কর্মসূচি পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কৌশল অব্যাহত রাখা হবে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এখন দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এগোচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। প্রথমটি হচ্ছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়। ১০ অক্টোবর এই রায়ের দিন ধার্য আছে। এই মামলায় তারেক রহমানের নিশ্চিত সাজা ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ। আর সাজা হলে বিএনপি মাঠে নামার চেষ্টা করতে পারে-এই চিন্তা থেকে গত সোমবার রাজধানীতে সপ্তাহব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি শুরু করা হয়। প্রায় ১০ লাখ প্রচারপত্র ছেপে বিলি করা হচ্ছে। এতে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে মানুষকে রুখে দাঁড়ানো এবং নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান রয়েছে।
এরপর শুরু হবে ১৪ দলের কর্মসূচি। ৯ অক্টোবর রাজশাহী, ১০ অক্টোবর নাটোর ও ১৩ অক্টোবর খুলনায় সমাবেশ করবে সরকারি দলের নেতৃত্বাধীন জোট। এরপর ময়মনসিংহ, রংপুরসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে সমাবেশ হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জেলায় জেলায় সফর কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে।
তারপরও সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা স্বস্তিতে নেই। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবকিছু ছকমতো হবে কি না এবং সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। দলের ভেতরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও দুশ্চিন্তার আরেকটা কারণ। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, দলের মনোনয়ন কারা পাচ্ছেন, তা আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দলীয় কোন্দল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন নীতিনির্ধারকেরা। উল্টো বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদের অনেকে বাদ পড়বেন এবং তরুণেরা প্রাধান্য পাবেন-এমন আলোচনা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে সবাই নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণে মাঠে সক্রিয় থাকেন।
পাশাপাশি প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখতে মামলা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়েছে, যা গায়েবি মামলা নামে পরিচিতি পেয়েছে। গত সোমবার ঢাকায় এমনই এক মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রুহুল কবির রিজভীসহ ৫৫ জনকে আসামি করেছে পুলিশ।
পুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎপরতাও থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে খন্দকার মোশাররফ, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টুসহ বিএনপির অন্তত ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে। সর্বশেষ আমীর খসরুর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চিঠিও দিয়েছে দুদক।
এসব বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপিসহ সরকারবিরোধীদের ধারণা, তাদের ব্যাপক জনসমর্থন আছে। ফলে একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ পেলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। কিন্তু সোমবারই বিএনপির একদল শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। অবস্থাটা যদি এমন দাঁড়ায় যে বিরোধীদের প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতাটাই কেড়ে নেওয়া হবে, তাহলে তো আগামী নির্বাচন যেভাবে মানুষ প্রত্যাশা করছে, এমনটা হবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলগুলোর প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে।