>• দীর্ঘ ২৮ বছর পর ১১ মার্চ ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হবে
• ডাকসুতে ২৫টি, একেকটি হলে ১৩টি পদে নির্বাচন হবে
• হল সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে যাচ্ছেন ৫৬ প্রার্থী
• হলগুলোতে প্রায় ২৪ শতাংশ বিনা ভোটে জিততে যাচ্ছেন
• বিভিন্ন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় নিয়ে সমালোচনা
বিনা ভোটে নির্বাচনের ঢেউ লেগেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হল সংসদ নির্বাচনে মোট ২৩৪টি পদের মধ্যে ৫৬ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। তাঁদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের প্রার্থী। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ২৫টি পদে ২২৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হওয়া নিয়ে সমালোচনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রায় ২৪ শতাংশ পদে বিনা ভোটে প্রার্থীরা জিততে যাচ্ছেন। বেশ কিছু প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, ছাত্রলীগের কিছু নেতার হুমকি-ধমকির কারণে তাঁরা সরে দাঁড়িয়েছেন। এ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাত্রসংগঠনগুলো পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে।
এতগুলো পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়া খুবই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। গতকাল রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন পর নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এতে সবাই অংশ নেবে এবং সেটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। ডাকসুর মতো আবাসিক হলগুলোতেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে নির্বাচন অর্থবহ হবে না।
গতকাল রোববার ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রাথমিকভাবে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া সহসভাপতি (ভিপি) পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল্লাহ জিয়াদ, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান ও বামপন্থী জোটের প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীরসহ পাঁচজন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। তবে এই পাঁচজনের একজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। এই হিসাবে ডাকসুতে ভিপি পদে ২১ জন, জিএস পদে ১৪ জন, সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ১৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ১১ মার্চ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ডাকসুতে ২৫টি পদে এবং একেকটি হলে ১৩টি পদে নির্বাচন হবে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮টি আবাসিক হল রয়েছে। সেই হিসাবে সব কটি হল সংসদে মোট ২৩৪টি পদে নির্বাচন হওয়ার কথা।
নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অন্তত ৫৬ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ৩ জন এজিএস, ৩০ জন সম্পাদকীয় পদ ও ২৩ জন সদস্য। তাঁদের অধিকাংশই ছাত্রলীগ প্যানেলের প্রার্থী।
বিভিন্ন আবাসিক হলের ৮ জন প্রার্থী প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের হুমকি-ধমকির মুখে তাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছেন। প্রত্যাহার করা এসব প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের বিভিন্ন পদে প্রার্থী ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শাফিকুল ইসলাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হল (এসএম হল) সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। ‘রাজনৈতিক কক্ষে’ থাকলেও হল শাখা ছাত্রলীগ কমিটিতে তাঁর কোনো পদ ছিল না। প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম নেই। এই হল সংসদে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে সমাজসেবা সম্পাদক পদে লড়ছেন মিলন খান। এই পদে শাফিকুল ছাড়া মিলনের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। শাফিকুলের ধারণা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে মিলন খান তাঁর পক্ষে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিয়েছেন।
অবশ্য মিলন খান প্রথম আলোর কাছে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আর হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক সাব্বীর আহমেদ বলেছেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একই হল সংসদে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর দুই জোটের জিএস প্রার্থী আবু সায়েম রাব্বী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে ফোনে হুমকি পেয়েছেন। একই পদে ছাত্রলীগ প্যানেলের প্রার্থী জুলিয়াস সিজারের কর্মী কানন মোল্লা এই হুমকি দেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে ফোনের রেকর্ডও রয়েছে তাঁর কাছে। যদিও কানন মোল্লা হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। আর হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেছেন, বিষয়টি তাঁরা দেখছেন।
জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কারণে অন্যান্য সংগঠন তেমন কাজ করতে পারেনি। এমন অবস্থায় নির্বাচন ঘোষণার পর ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যদের প্যানেল ঘোষণা দুরূহু ব্যাপার ছিল। এমনকি ছাত্রলীগের সঙ্গে থাকা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও ভয়ভীতির কারণে প্যানেল দিতে পারেনি। তবে তাঁর আশা, দীর্ঘদিন পর এই নির্বাচন হলে আস্তে আস্তে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিটা কেটে যাবে।
বিনা ভোট নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী প্রথম আলোকে বলেন, হলগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দখলদারত্ব থাকার কারণে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান ছিল না। অন্য ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা হলে উঠতে চাইলেও পারেননি। পরিচয় পাওয়ার পর হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অনেক ছাত্রসংগঠন চাইলেও তাই প্রার্থী দিতে পারেনি। এ কারণেই বিনা ভোটের এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এত প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটা হলে হলে ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের দখলদারত্ব ও প্রশাসনের ছাত্রলীগবান্ধব ভূমিকার ফল।
অবশ্য ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুতে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে এজিএস প্রার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘এটি প্রমাণ করে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ আশ্রয়। যারা অভিযোগ করছে, তাদের অনেকে হলগুলোতে ঠিকমতো প্যানেলই দিতে পারেনি। তাদের মুখে এ ধরনের অভিযোগ মানায় না। তাদের আমরা অভিযোগনির্ভর ছাত্রসংগঠন না হয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব সংগঠন হওয়ার আহ্বান জানাই।’
ডাকসুর কোন পদে কতজন
চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, ডাকসুতে ভিপি পদে লড়ছেন ২১ জন। তাঁরা হলেন রেজওয়ানুল হক চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান, লিটন নন্দী, অরণি সেমন্তি খান, আবদুল্লাহ আল লাবিব, আবদুল্লাহ জিয়াদ, এ ডি এম আব্বাস-আল্-কোরেশী, এস এম আতায়ে রাব্বী, ওমর ফারুক, নকিবুল হাসান, ফাহমিদা মজিদ, আবদুল আলীম, গোলাম রাসেল, টিটো মোল্যা, নাইম হাসান, নুরুল হক, রাকিবুল ইসলাম, রাসেল শেখ, শফিকুল ইসলাম, শিহাব শাহরিয়ার ও সফিক সরকার।
জিএস পদে ১৪ প্রার্থী হলেন গোলাম রাব্বানী, আনিসুর রহমান, উম্মে হাবিবা, এ আর এম আসিফুর রহমান, জালাল আহমেদ, ফয়সাল মাহমুদ, মামুন ফকির, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, রাশেদ খান, রাশেদুল ইসলাম, শফিকা রহমান শৈলী, শাফী আবদুল্লাহ, শাহরিয়ার রহমান ও সনম সিদ্দিকী।
এজিএস পদে ১৩ প্রার্থী হলেন অমিত প্রামাণিক, অনুপ রায়, আশরাফুল আলম ফাহিম, ফারাহ মাহযাবিন, আবু রায়হান, খোরশেদ আলম, জহুরুল ইসলাম, ফারুক হোসেন, সাদ্দাম হোসেন, রহমত উল্যাহ, শরীয়ত উল্লাহ, শাহিদুল ইসলাম ও সাদেকুল ইসলাম।
এ ছাড়া স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক পদে ১১ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ৯ জন, কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯ জন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে ১১ জন, সাহিত্য সম্পাদক পদে ৮ জন, সংস্কৃতি সম্পাদক পদে ১২ জন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১১ জন, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১০ জন, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৪ জন এবং ১৩টি সদস্য পদে ৮৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
ইশা ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদ
গতকাল প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর চাপ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একাংশের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামী শাসনতন্ত্র (ইশা) ছাত্র আন্দোলন। প্রতিবেদনে বলা হয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ধর্মভিত্তিক সংগঠন ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ।
ইশা ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি শেখ ফজলুল করীম ও সাধারণ সম্পাদক মুস্তাকিম বিল্লাহ এক বিবৃতিতে বলেন, ক্যাম্পাসে কারও রাজনীতি করার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার পরিবেশ পরিষদ রাখে না। ‘ধমীয় সংগঠনের’ স্বীকৃত সংজ্ঞা নেই উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, ইশা ছাত্র আন্দোলনের মতো আদর্শিক সংগঠনকে ধর্মীয় সংগঠন বলে নিষিদ্ধের তকমা লাগানো সংবিধানবিরোধী।