বিএনপি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। দেশটির সঙ্গে বিভিন্ন সময় সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে তারা। এমনকি এ বছরের আগস্টে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের সঙ্গে ব্যাংককে একটি বৈঠকের দিন ঠিক করার চেষ্টাও করেছিল বিএনপি। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেই এ কথা বলেছেন। একই সাক্ষাৎকারে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য, অবসর সময়ের ভালো লাগার বিষয়গুলোও উঠে এসেছে।
আগামীকাল রোববার বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় এই আলাপচারিতা। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, ‘এখানে কোনো নির্বাচনী প্রচার নেই। এটা সন্ত্রাসের রাজত্ব, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের।’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন। তাঁর ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী তারেক জিয়া দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে দলের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় আছেন মির্জা ফখরুল। ঢাকার গুলশানে বিএনপির কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারটি দেন তিনি।
মির্জা ফখরুলের প্রথম অভিযোগ ছিল ক্ষমতাসীনেরা কীভাবে পুলিশকে ব্যবহার করছে, তা নিয়ে। তাঁর ভাষায়, ‘ভয়াবহ অবস্থা’। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও ৩২ বছর বয়সী শিক্ষক মেয়ে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পেড়েছেন। আমি ভাবতেও পারিনি এমন পরিস্থিতি হতে পারে।’
খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে তিনবার দেখা করতে পেরেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার আগে তাঁর (খালেদা জিয়া) অনুমতি নিয়েছি।’ তিনি তারেকের সঙ্গেও পরামর্শ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি। আমরা উদার গণতান্ত্রিক দল। আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।’
ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা দেশের বাইরে ভারতের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম। আমরা ভারতীয় হাইকমিশনারের সাক্ষাৎ চেয়েছিলাম। তিনবার দেখা করেছি। ভারতীয় কূটনীতিকেরা সাক্ষাৎ করতে তেমন আগ্রহী নন বলে মনে হয়েছে। সম্ভবত তাঁরা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে দেখা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরাগভাজন হতে চাননি।’ এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। আমরা সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদে বিশ্বাস করি না। এ বিষয়ে আমাদের নিয়ে ভারতের ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। এটা পুরোপুরি মিথ্যা ধারণা যে আমরা ভারতবিরোধী। এটা আওয়ামী লীগের সৃষ্ট অপপ্রচারের অংশ।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছি। আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১২ সালে দিল্লি সফর করেন। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর (খালেদা জিয়া) খুবই সফল বৈঠক হয়েছিল। তবে এরপর আর কিছু ঘটেনি। আর কোনো ফলোআপ নেই। আমরা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমরা এ বছরের আগস্টে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের সঙ্গে ব্যাংককে বৈঠকের দিন ঠিক করার চেষ্টা করেছি। তবে ভারতীয় পক্ষ এড়িয়ে গেছে।’
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মাখামাখি প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জামায়াত বিষয়ে আমাদের প্রশ্ন করা হলে আমি বলি, দেখুন, বিএনপি জামায়াত নয়। বিএনপি ইসলামি আইনে বিশ্বাস করে না। বিএনপি মৌলবাদে বিশ্বাস করে না। জামায়াতের জন্য আমাদের কোনো মোহ নেই।’ মির্জা ফখরুল যখন এ কথা বলছিলেন, তখন তাদের জোট থেকে বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন ২২ জামায়াত নেতা। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুলের ভাষ্য, ‘জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য একটি কৌশলগত ঐক্য। তাদের সঙ্গে থাকার কারণে অন্তত ৫০টি আসনে সুবিধা পাওয়া যাবে। আমাদের ছাড়া তাদের মাত্র তিনটি আসন কমবে।’
২০০১-০৬ সালের শাসনামলে বিএনপির শরিক হিসেবে জামায়াত ভারতের প্রতি তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ ছিল। এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিজেপি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল। আরএসএসও সেখানে আছে। আমাদের তাদের (জামায়াত) সঙ্গে কোনো সমস্যা নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমি বুঝতে পারি না ভারত কেন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতন, গুম, খুনের মতো অপকর্মগুলো দেখেও না দেখার ভান করে। সাধারণ মানুষের মনে একটা ধারণা আছে, ভারত আওয়ামী লীগকে সহায়তা করে। আওয়ামী লীগ একটি ঘৃণিত রাজনৈতিক দল। তবে শুধু ভারতের কারণে তারা টিকে আছে। ভারতই আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করছে।’ তাঁর অভিযোগ, পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনের ‘ভালো যোগাযোগ’ রয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য এখন ‘ভোটের অধিকার’ ও ‘স্বাধীনভাবে বাঁচা’; যাতে পুলিশ কাউকে তুলে নিয়ে না যায়। ‘জিয়া পরিবারকে ছাড়া বিএনপির কথা অকল্পনীয়’—মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া ক্যারিশমাটিক নেত্রী।’
অবসর সময়ে মির্জা ফখরুল বাংলা ভাষার ধ্রুপদি চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের সিনেমা তাঁর প্রিয়। পছন্দের তালিকায় আছে স্বনামধন্য বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ছবি। জানালেন, সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ আর ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ তাঁর প্রিয় সিনেমা। তাঁর পছন্দের তালিকায় আছেন গোবিন্দ নিহালানি, গৌতম ঘোষ আর নন্দিতা দাশ। তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা কখনো আমার নেই। দলের নেতারা যা করতে বলবেন, আমি তা-ই করব।’