‘আর্থিক সুবিধা’ নিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দেওয়ার শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে। গত সপ্তাহে ঘটল আরও দুটি ঘটনা। এর ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা বিনা শ্রমে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন।
এ ঘটনাগুলোকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির একটা প্রভাব বলে মনে করছেন জাপার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তাঁদের মতে, রাজনীতির স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গেছে।
সর্বশেষ ঢাকা-১৪ আসনের উপনির্বাচন থেকে গত বৃহস্পতিবার সরে দাঁড়ান সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান। দলকে না জানিয়ে তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আগা খানকে (মিন্টু) গতকাল শুক্রবার বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এর আগে কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং–ব্রাহ্মণপাড়া) আসনেও জাপার প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিন একই কাজ করেন। সেখানে আওয়ামী লীগের আবুল হাসেম খানও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন।
আগামী ২৮ জুলাই ঢাকা-১৪, কুমিল্লা-৫ ও সিলেট-৩ আসনে ভোট গ্রহণের তারিখ ছিল। এখন বাকি রইল সিলেট-৩ আসন। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিবুর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন জাপার প্রার্থী আতিকুর রহমান। বিএনপি ও তার জোট এই নির্বাচনে নেই।
ঢাকায় ও কুমিল্লায় জাপার প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোর নেপথ্যে আর্থিক লেনদেন রয়েছে বলে দলের ভেতরে–বাইরে আলোচনা আছে। জাপার একাধিক নেতা বলেন, মাঠে নামার আগেই কোনো কারণ ছাড়াই যেভাবে দুজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়, তাঁরা নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছেন।
তবে ঢাকা-১৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ আগা খান আর্থিক সমঝোতার কথা অস্বীকার করেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাকুর রহমানকে আমি চিনি না। তাঁর সঙ্গে আমার কোনো আলাপও হয়নি। আর টাকাপয়সা তো পরের কথা।’
জাপা সূত্র জানায়, এই উপনির্বাচনে দলের দুই প্রার্থীর কেউই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার আগে নির্বাচনী এলাকার দলীয় নেতা বা কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের কিছু জানাননি। ঢাকা-১৪ আসনের শাহ আলী থানা জাতীয় পার্টির সভাপতি মাহফুজ মোল্লা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনোনয়ন প্রত্যাহারের খবর শুনে আমি ওনাকে (মোস্তাকুর রহমান) ফোন করি। জিজ্ঞেস করি, “ভাই, ভোটে দাঁড়ানোর সময় বললেন; কিন্তু প্রত্যাহারের সময় কিছুই জানালেন না, ব্যাপার কী।” তিনি বলেছেন, তিনি নাকি দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন আমরা আর্থিক লেনদেনের নানা কথা শুনছি।’
মোস্তাকুর রহমানও টাকার বিনিময়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাহলে এমন কী পরিস্থিতি হয়েছে যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলেন? জবাবে মোস্তাকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মারধর না করলেও আমার নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল। আমি দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে বলেছি, এভাবে নির্বাচন করতে পারব না।’
মোস্তাকুর রহমানের এই বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বাজে কথা। মাঠে কোনো চাপ ছিল না।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কুমিল্লা-৫ আসনে জাপার প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিন গত রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল হাসেম খানকেও সঙ্গে নিয়ে যান। ওই দিন জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘করোনার সময়, এলাকার লোকজনও আমাকে ধরেছেন নির্বাচন না করার জন্য। উনি (আওয়ামী লীগ প্রার্থী) মুরব্বি মানুষ, তাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।’
এরপর থেকে জসিম উদ্দিন আর প্রকাশ্যে নেই। তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ। নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, টাকার বিনিময়ে জসিম উদ্দিন দলের কাউকে না জানিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল হাসেম খান অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘জসিম আমার কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি, শুধু বলেছিলেন, আমার দিকে খেয়াল রাখবেন। দলের নেতা-কর্মীদের দিকে খেয়াল রাখবেন।’
এর আগে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে টাকার বিনিময়ে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যান মহাজোটের মনোনয়ন পাওয়া জাপার প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদ ইসলাম (পাপুল) থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে তখন এলাকায় প্রচার ছিল। পরে নোমানকে দল থেকে বহিষ্কার করে জাপা।
ওই নির্বাচনে শহিদ ইসলাম সাংসদ হন। বর্তমানে তিনি কুয়েতে মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে দণ্ডিত হয়ে জেলে আছেন। তাঁর সংসদ সদস্যপদও বাতিল হয়েছে।
শহিদ ইসলামের শূন্য আসনে গত ২১ জুন উপনির্বাচন হয়। জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী নূর উদ্দিন চৌধুরী। সেখানে জাপার প্রার্থী ছিলেন শেখ মোহাম্মদ ফায়িজ উল্ল্যাহ।
জাপার দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এই উপনির্বাচনেও জাপার প্রার্থীকে সরিয়ে নিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নূর উদ্দিন চৌধুরী চেষ্টা করেন। তিনি ঢাকার বনানীতে জাপার কার্যালয়ে গিয়ে দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলেন। নূর উদ্দিন চৌধুরীর প্রস্তাবে তিনি রাজি হননি।
কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের একের পর এক বসে পড়ায় জাপার নীতিনির্ধারকেরা বিব্রত। মোস্তাকুর রহমান ও জসিম উদ্দিনের দলের প্রাথমিক সদস্য বাতিল এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে জাপা। জসিম উদ্দিন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় দলের সভাপতি ছিলেন।
কুমিল্লা-৫ আসনের প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ঢাকার ঘটনায় এখনো কমিটি করা হয়নি।
দলীয় সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে নির্বাচনগুলো হচ্ছে, তাতে উপনির্বাচনে জোরদার প্রার্থী না থাকলে অংশগ্রহণ না করার পক্ষে দলের কারও কারও মত ছিল। যেসব জায়গায় শক্ত প্রার্থী আছে, সেগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরামর্শ ছিল। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সব পর্যায়ের দলের অবস্থান জানান দিতে সব নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে।
এ বিষয়ে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্তই ছিল, নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত মাঠে থাকতে হবে। কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মাঝ পর্যায়ে সরে গেলে দল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হবে না।’
তবে কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, স্থানীয় সরকারের পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও বিভিন্ন সময়ে জাপার প্রার্থীরা সমঝোতা করে ভোট থেকে সরে গেছেন বলে জানা গেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, দেশে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনীতি যে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে, তার নগ্ন রূপ হচ্ছে মনোনয়ন বিক্রি করে দেওয়া।