বিএনপির ‘বৃহত্তর ঐক্য’ খুব একটা এগোয়নি

দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও চিড় ধরেছে।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বৃহত্তর সর্বদলীয় ঐক্য গড়ার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত এর ভিত্তি গড়তে পারেনি বিএনপি। উল্টো দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও চিড় ধরেছে। এই দুই জোটে থাকা দুটি দল ইতিমধ্যে পৃথক রাজনৈতিক জোট গঠনের কাজ শুরু করেছে। সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া বিএনপি শুরু করেছে, তা এখন পর্যন্ত খুব একটা এগোয়নি।

তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ‘এই সরকারের অধীন নির্বাচন নয়’—এই এক দফা দাবিতে রাজপথে সর্বদলীয় ঐক্য গড়ার যে চেষ্টা তাঁরা করছেন, সেটি সক্রিয় আছে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকেরাসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেতাদের আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় সবাই একমত পোষণ করেছে, নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে কেউ নির্বাচনে যাবে না। এটাকে ভিত্তি ধরেই একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার চেষ্টা এগিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।

‘আমরা একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যেই এটা (সাত দল ও সংগঠন মোর্চা) শুরু করেছি। তবে এটা কোনোভাবেই বিএনপির জোটের প্রতিস্থাপন নয়।’
মাহমুদুর রহমান মান্না, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহ থেকে ঐক্য প্রক্রিয়ার কাজ আবার শুরু করবে বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির আগামী বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য প্রচেষ্টার মধ্যেই পাঁচটি দল ও দুটি সংগঠন নতুন রাজনৈতিক ‘মোর্চা’ গঠনে বৈঠক করেছে, যাদের অধিকাংশের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের আলোচনা চলছিল। দলগুলো হচ্ছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। সংগঠন দুটি হচ্ছে ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এর মধ্যে আ স ম আবদুর রবের দল জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক। বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যেই এই সাতটি দল ও সংগঠনের জোটবদ্ধ হওয়া নিয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। জোটবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা এই সাত দল ও সংগঠন ২৩ মে বৈঠক করে তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যেই এটা (সাত দল ও সংগঠন মোর্চা) শুরু করেছি। তবে এটা কোনোভাবেই বিএনপির জোটের প্রতিস্থাপন নয়।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, বামসহ কয়েকটি দলের নতুন ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ তৈরির প্রক্রিয়াকে তাঁরা ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, এখানে দেখার বিষয় একটিই, সেটা হচ্ছে যে যা-ই করুক, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক আছে কি না, তা। এ ক্ষেত্রে সাত দল ও সংগঠনের নেতারা স্পষ্ট করে বলেছেন, এই সরকারের অধীনে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না, এ বিষয়ে সবাই একমত। তাঁরা এটাও বলেছেন, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।

এখন সবাই বলছে,অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। মূল জায়গায় সবাই যখন এক হয়েছে, বাকিটাও হয়ে যাবে।
ইকবাল হাসান মাহমুদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

এ দিকে নানা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কারণে ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও দূরত্ব রাখছে বিএনপি। সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে জোটের শরিক কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সঙ্গেও। বিশেষ করে দুই ভাগে বিভক্ত এলডিপির আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বাধীন অংশের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সখ্য ও যোগাযোগ রয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার অলি আহমদের এলডিপি থেকে দুই শতাধিক নেতার একযোগে পদত্যাগ করে শাহাদাত হোসেন সেলিমের এলডিপিতে যোগদানের ঘটনা ২০-দলীয় জোটে অলি আহমদকে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।

বিএনপির নেতারা মনে করছেন, এই সরকারের অধীন নির্বাচন নয়—এটাকে লক্ষ্য ধরে ইতিমধ্যে সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলের মধ্যে অলিখিত ঐকমত্য দৃশ্যমান হয়েছে। এই লক্ষ্যকে সংহত করার জন্য দলের নীতিনির্ধারকেরা কর্মপরিকল্পনা করছেন।

বিএনপির হয়ে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে বলেই তো সবাই জাতীয় ঐকমত্যের দিকে এগোচ্ছে। এখন সবাই বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। মূল জায়গায় সবাই যখন এক হয়েছে, বাকিটাও হয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনের পর রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচির বিষয়ে ঐকমত্যে আসা দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বা চুক্তিতে যাবে বিএনপি। এর ভিত্তিতেই রাজপথে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একটি বৃহত্তর ঐক্য স্থাপিত হবে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। এ কারণে পুরোনো দুই মিত্রজোটকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে। এই মুহূর্তে ঘটা করে সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গড়া তাদের লক্ষ্য নয়।

নাম না প্রকাশের শর্তে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি কীভাবে ঐক্য চায়, কাদের নিয়ে চায়, এটা এখনো পরিষ্কার নয়।