বিএনপির রাজনৈতিক অসংগতি ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দলটির নেতৃত্বাধীন দুই জোট থেকে বেরিয়ে গেছে দুটি দল—বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এখন আরও অন্তত চারটি দল জোট ছাড়তে সরকারমুখী যোগাযোগ ও তৎপরতা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে ২০-দলীয় জোটের আরেক শরিক এলডিপি সক্রিয় হয়েছে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে। শরিকদের এসব নানামুখী তৎপরতায় অস্বস্তিতে পড়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
জোটের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি—এ চার দল একত্রে জোট ছাড়তে তৎপরতা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে সরকারসংশ্লিষ্ট একটি পক্ষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগও হয়েছে। বিষয়টি এনডিপি ও লেবার পার্টির দুই প্রধান নেতা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন।
তবে এনডিপির চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের বলেন, বিষয়টি আপাতত স্থগিত আছে। আর লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে মহলবিশেষের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়েছিল। এখন এর কোনো অগ্রগতি নেই। বিএনপি এখন জোটের শরিকদের গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি ওই প্রক্রিয়া থেকে দূরে আছেন।
সরকারসংশ্লিষ্ট ওই পক্ষ এর আগে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট, শওকত হোসেনের এনপিপিসহ কয়েকটি দলের বিএনপির জোট ছাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, নির্বাচনের আগে একেক দল একেক আশা নিয়ে জোট করেছে। কিন্তু নির্বাচনে অনেকের আশা ভঙ্গ হয়েছে। এখন তারা হয়তো নতুন কোনো আশায় নতুনভাবে পথ খোঁজার চেষ্টা করছে, রাজনীতিতে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কয়েকটি দলের বেরিয়ে যাওয়াকে খুব গুরুত্ব দিতে রাজি নন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দু-একটা লোক বেরিয়ে যাচ্ছে, যাবে। এটা বরাবরই হচ্ছে, হবে। সবাই তো আর চিরস্থায়ী হয় না।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিজেপির আন্দালিভ রহমান (২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছেন) এবং কাদের সিদ্দিকী (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে গেছেন) বা আরও ছোট কোনো দলের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনার চেয়ে এই মুহূর্তে বিএনপি কিছুটা উদ্বিগ্ন এলডিপির অলি আহমদের তৎপরতা নিয়ে। কারণ, তিনি বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় সামনে রেখে মাঠে নেমেছেন, যার নাম দিয়েছেন ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’। এর একটি হচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি, অন্যটি কারাবন্দী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি।
বিএনপির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার কারামুক্তির দাবি দলের সমর্থকদের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। এটিকে মুখ্য করে অলি আহমদ নতুন রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে এই ইস্যুতে অলি আহমদ যদি সহানুভূতি পেয়ে যান, তা হবে তাঁদের জন্য বিব্রতকর। কারণ, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনতে বিএনপি গত দেড় বছরে সরকারের ওপর কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি, এখন পর্যন্ত তাদের সে চেষ্টা বা কর্মসূচিও দৃশ্যমান নয়। আবার অলি আহমদের এই উদ্যোগে ২০-দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক দল জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), খেলাফত মজলিস ও ন্যাশনাল মুভমেন্ট—এই পাঁচ দলকে দেখা গেছে।
গত ২৭ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে অলি আহমদ জাতীয় মুক্তি মঞ্চের নাম ঘোষণা করেন। এরপর তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ১ জুলাই চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সমাবেশ করেন। ১৬ জুলাই সিলেট প্রেসক্লাবে মধ্যবর্তী নির্বাচন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় মুক্তি মঞ্চ। পর্যায়ক্রমে সব বিভাগীয় শহরে, এরপর জেলা পর্যায়ে সভা-সমাবেশ করবে মুক্তি মঞ্চ।
বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্বিগ্ন হওয়ার আরও কারণ হচ্ছে, অলি আহমদ দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক। তিনি হঠাৎ খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কেন, কী উদ্দেশ্যে সক্রিয় হলেন, এর পেছনে দেশের ভেতরে-বাইরের কারও হাত আছে কি না, তা বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতারা। এ রকম চিন্তা থেকে ২০ দলের কোনো শরিক যাতে অলি আহমদের মুক্তি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত না হয়, সে জন্য বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে অনেককে ফোন করে অনুরোধ করা হয়েছে।
অবশ্য এলডিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এই উদ্যোগের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। বিএনপির নেতৃত্বের ব্যর্থতাই অলি আহমদকে মাঠে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছে।’
এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০-দলীয় জোট—কোন জোটকে কীভাবে সমন্বয় বা প্রাধান্য দিয়ে পরবর্তী পথচলা ঠিক করবেন, তা নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন বলে জানা গেছে। দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট বা ২০-দলীয় জোট নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করি না। আমাদের চলার পথটা দীর্ঘ। সবাই শেষ পর্যন্ত থাকবে না। কেউ যদি যেতে চায়, যাবে। কিন্তু যাওয়ার জন্য বিভিন্ন অজুহাত দেওয়ার দরকার কী?’