নির্বাচন কমিশন গঠন

প্রস্তাবকারী ও চূড়ান্ত ১০ নামের তালিকা প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক

নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে অনুসন্ধান কমিটির কাছে জমা পড়া সব নামই প্রকাশ করা হয়েছে। তবে কে কোন নাম প্রস্তাব করেছে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে যে ১০ জনের নামের তালিকা পাঠানো হবে, তা প্রকাশ করা হবে কি না—এ বিতর্ক রয়েই গেছে।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কেউ কেউ বলছেন, এসব নামের প্রস্তাবকারী রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তির নামও প্রকাশ করা উচিত। আর তা করা হলে ইসি গঠনে স্বচ্ছতা আসবে।

এদিকে নাম প্রস্তাবকারী কিছু দল রাষ্ট্রপতির কাছে যে ১০ জনের নামের তালিকা পাঠানো হবে, সেটা প্রকাশ করার দাবি করেছে। তারা মনে করে, এটা প্রকাশিত হলে তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বিষয়ে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ পাওয়া যাবে। সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বিবেচনায় কোন কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, তারও একটা ধারণা পাওয়া যাবে। আর কে, কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশ পেলে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা কোন দলের তালিকা থেকে এসেছেন, সেটাও মানুষ জানতে পারবে। এ ছাড়া যেসব নাম একাধিক দলের তালিকায় ছিল, সেগুলোই অনুসন্ধান কমিটি বেশি গুরুত্ব দিয়েছে কি না, তা–ও বোঝা যাবে।

এর আগে ২০১৭ সালে ইসি গঠনের আগে যে অনুসন্ধান কমিটি হয়েছিল, তারা কোনো নামের তালিকা প্রকাশ করেনি। তবে তখন রাজনৈতিক সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের জোট ১৪ দলের শরিক ও সমমনা দলগুলোকে দিয়ে কিছু পছন্দের নাম প্রস্তাব করিয়েছিল। মূল লক্ষ্য ছিল পছন্দের নামগুলো বেশি সংখ্যক দলের তালিকায় থাকুক। পরে অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো বেশি সংখ্যায় এসেছে, সেগুলোকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। নিয়োগ পাওয়ার পর দেখা যায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) চারজনের নাম আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর তালিকায় ছিল। সিইসি নিয়োগ পাওয়া কে এম নূরুল হুদার নাম অন্তত পাঁচটি দলের তালিকায় ছিল। এবারও বেশিসংখ্যক দল, সংগঠন ও ব্যক্তির প্রস্তাবে যেসব নাম এসেছে, সেগুলো বাড়তি গুরুত্ব পেতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

এ বিষয়ে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গত রোববার রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে ১০ জনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ অথবা সেই তালিকা সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠিয়ে আলোচনার অনুরোধ জানিয়েছেন। এর ফলে অনুসন্ধান কমিটির ওপর সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করার বিষয়ে চাপ তৈরি হবে। আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে। তবে তিনি মনে করেন, কে কার নাম প্রস্তাব করল, তা প্রকাশ করা ঠিক হবে না।

অনুসন্ধান কমিটিতে আসা ৩২২ জনের নামের তালিকা গত সোমবার প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। দেশের ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৪টি নাম জমা দিয়েছে। এর বাইরে কিছু পেশাজীবী সংগঠন এবং ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ নাম প্রস্তাব করেছেন। বিএনপি ও তাদের দল এবং বামপন্থী কিছু দল নাম জমা দেয়নি। নাম জমা দেওয়া দলগুলোর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক কিংবা সরকারঘেঁষা হিসেবে পরিচিত।

১৪ দলের সূত্র বলছে, নাম জমা দেওয়া ২৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে আটটি ১৪ দলের শরিক। আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে—বিকল্পধারা বাংলাদেশ, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাপ ও বিএনএফের। এর বাইরে ধর্মভিত্তিক কিছু দল সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে।

রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রস্তাবকারী দলের নাম প্রকাশিত হলে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ও সরকারঘেঁষা দলগুলোর তালিকা থেকে এসেছেন, সেটা সামনে আসতে পারে।

১৪ দলের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু মনে করেন, ১০ জনের তালিকা প্রকাশ করা দরকার। এতে জনসাধারণ তাঁদের বিষয়ে মতামত দিতে পারে। পাঁচ-ছয় দিন সময় দিলে রাষ্ট্রপতির পক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। একই দাবি করেছেন এ জোটের আরেক শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন।

রাশেদ খান মেননের মতো ইনুও প্রস্তাবকারী দলের নাম প্রকাশ না করার পক্ষে মত দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের দাবি ছিল নাম প্রকাশ করা, অনুসন্ধান কমিটি তা করেছে। তাঁর মতে, কে কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশ করার দাবি অযৌক্তিক। এতে সম্মানিত ব্যক্তিদের ওপর দলীয় তকমা পড়ে যাবে। আর ১০ জনের তালিকা প্রকাশ করা না, করা অনুসন্ধান কমিটির এখতিয়ার।

১৪ দলের সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের মতো এবারও একই কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। জোটের শরিক এবং সমমনা দলগুলোকে দিয়ে পছন্দের কয়েকটি নাম অনুসন্ধান কমিটিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। তবে এবার শরিক দু–একটি দল এ কৌশলে সাড়া দেয়নি।

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এবং মন্ত্রী পেশাজীবী সংগঠনগুলোকেও পছন্দের নাম দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে যেসব নাম জমা হয়েছে, সেগুলোতেও আওয়ামী লীগের পছন্দের কিছু নাম রয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত কোনো বিষয় ব্যক্তিগত তথ্য নয়। এগুলো প্রকাশ করার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। স্বচ্ছতার স্বার্থে অনুসন্ধান কমিটিতে আসা নাম তিন স্তরে প্রকাশ করতে হবে। প্রথমত, সব নাম গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ। এরপর কে কার নাম প্রস্তাব করল, তা প্রকাশ। এরপর ১০ জনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তাহলে অনুসন্ধান কমিটি কোন নির্ণায়কের মাধ্যমে ব্যক্তিদের বাছাই করেছে, তা বোঝা যাবে।