যেসব দল নামের প্রস্তাব করেনি, তাদের জন্য আজ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সময়। আজ সন্ধ্যায় সব নাম প্রকাশ করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অনুসন্ধান কমিটিতে নাম দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আজ সোমবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনারদের নামের প্রস্তাব দেয়নি, তারা এই সুযোগ নিতে পারবে। এরপর জমা হওয়া সব নাম আজ সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। তবে কোন দল কার কার নাম প্রস্তাব করেছে, সেই তথ্য প্রকাশ করা হবে না।
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে দুই দিন বৈঠক করেছে। গতকাল রোববার শেষ দিনের বৈঠকের শুরুতে অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সময় বৃদ্ধি এবং অনুসন্ধান কমিটির কাছে জমা হওয়া সব ব্যক্তির নাম প্রকাশ করার কথা জানান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়েও এই তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
আগামী নির্বাচন যদি আগের মতো হয়, তবে আমরা একটা বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। রাজনীতির যত খেলাই হোক না কেন, নির্বাচন যতক্ষণ গ্রহণযোগ্য না হবে, আমাদের সমস্যা আছে।এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার
বিশিষ্ট নাগরিকদের কয়েকজন বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁদের বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং ইসিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন—এমন ব্যক্তিদের বাছাই করতে হবে। যাঁরা হবেন সৎ ও সাহসী এবং রাজনৈতিক দলের চাপে মাথা নত করবেন না। স্বাধীনতাবিরোধী কাউকে বাছাই করা যাবে না।
সুপ্রিম কোর্ট কনফারেন্স লাউঞ্জে গতকাল বিকেল চারটার দিকে বৈঠক শুরু হয়। শুরুতে কথা বলেন অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি এ সময় বিএনপিকে দেশের একটি বড় দল উল্লেখ করে বলেন, ‘বিএনপি, সিপিবি, বাসদ—তারা এখনো নাম জমা দেয়নি। তারা যদি দিতে চায় আগামীকাল (আজ সোমবার) পাঁচটার মধ্যে তাদের জন্য সময়টা বর্ধিত করলাম। আশা করি, তারা পজিটিভ রেসপন্স করবে।’ তিনি বলেন, অনুসন্ধান কমিটির কাছে জমা হওয়া নাম প্রকাশের একটা দাবি এসেছে। যত নামই আসুক, সব প্রকাশ করে দেওয়া হবে।
বৈঠকে ছিলেন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি প্রস্তাবে আসা নামগুলো প্রকাশ করার কথা বলার পর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার কোন রাজনৈতিক দল কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশ করার পরামর্শ দেন। তখন উপস্থিত চার-পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক এর বিরোধিতা করেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে রাজনৈতিক দলের নাম প্রকাশের বিষয়টি আর এগোয়নি।
বৈঠক শেষে বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের তাঁর দেওয়া পরামর্শ সম্পর্কে বলেন, ‘স্বনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে। এর মানদণ্ডগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এর মাধ্যমে আস্থার সংকট দূর হবে। শুধু নাম প্রকাশ করলে হবে না। কোন দল কার নাম প্রস্তাব করল, সেই বিষয়গুলো সবার সামনে প্রকাশ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে যে নামগুলো এসেছে, সেই নামগুলো থেকে লোক নেওয়ার মধ্যে স্বচ্ছতা তৈরি হবে না। যদি কোন দল কোন নাম প্রস্তাব করেছে, সেভাবে প্রকাশ করা না হয়, তবে একধরনের গোপনীয়তা থেকে যাবে। যার ফলে স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন গঠন করা কখনো সম্ভব হবে না।’
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মজুমদার সাহেব (বদিউল আলম মজুমদার) বলেছিলেন রাজনৈতিক দলগুলো কার কার নাম প্রস্তাব করেছে, সেটা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে। কিন্তু আমরা সেটার বিরোধিতা করেছি। বলেছি সবার নাম যাক, তবে কে কোন নাম প্রস্তাব করেছে, সেটা বলা বাঞ্ছনীয় নয়। তাহলে একটা মার্কা হয়ে যাবে।’
নাগরিক সমাজ, নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জানিয়ে মুনতাসীর মামুন বলেন, সবাই ইসিতে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ ও ‘আস্থাভাজন’ ব্যক্তি চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে কখনো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ইসির পক্ষে সুষ্ঠুভাবে ভোট করা সম্ভব নয়। নির্বাচনে অনেক অংশীজন রয়েছে, যেমন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, ভোটার। সবকিছু ইসির একার ওপরে চাপিয়ে দিলে হবে না।
সবাই ইসিতে বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাভাজন ব্যক্তি চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে কখনো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি পাওয়া যাবে না।অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ইতিহাসবিদ
বৈঠক শেষে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের ইলেকশন প্রসেস এবং ইলেকশন কমিশন ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সমস্ত লোক দরকার, যারা এটাকে টেনে তুলতে পারবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে এবং একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবে, এ রকম সাহসী লোক দরকার।’ তিনি গত দুটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আগামী নির্বাচন যদি আগের মতো হয়, তবে আমরা একটা বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। রাজনীতির যত খেলাই হোক না কেন, নির্বাচন যতক্ষণ গ্রহণযোগ্য না হবে, আমাদের সমস্যা আছে।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংবিধানে বলা আছে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এখানে বলা নেই দলীয়ভিত্তিক নির্বাচন কমিশনের কথা। কোনো দল যদি নাম দিয়ে থাকে, তিনি সাহসী হতে পারেন, ভালো হতে পারেন; তথাপি তাঁর ওপর দলের ছাপ পড়ে যাবে। যেটা আমরা গত নির্বাচন কমিশনে দেখেছি। যতগুলো নাম দিয়েছে সব কটি নাম প্রকাশ করা হোক। আর যদি স্বাধীন নির্বাচনের কথা বলেন, তাহলে দলের প্রস্তাব নিতে আমার আপত্তি আছে।’ অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে ১০ জনের নাম দেবে, সেগুলো প্রকাশ করা উচিত কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই প্রকাশ করা উচিত।’
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ দেশে এখনো স্বাধীনতাবিরোধী লোক আছে। তারা কি একজন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে গ্রহণ করবে? কাজেই সর্বজন গ্রহণযোগ্য কথাটা একটু জটিল। আমরা সার্চ কমিটিকে বলেছি, আপনারা ভয় পাবেন না। আপনারা বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকেন। কে কী বলছে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।’ তিনি বলেন, যিনি নির্বাচন কমিশনার হবেন, তাঁর অন্য সব গুণ থাকতে হবে, পাশাপাশি তাঁকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একজন মানুষ হতে হবে। যাঁরা নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার, দলীয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন না—এমন ব্যক্তিদের বাছাই করতে হবে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘সৎ, দুর্নীতিমুক্ত ও সাহসী এবং নির্ভীক মানুষ চাই আমরা। এমন একটি নির্বাচন কমিশন চাই, যেটি প্রভাবমুক্ত অবস্থায় নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে।’
লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘যাঁরা নির্বাচিত হবেন তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হবেন। সংবিধানে বিশ্বাস করতে হবে। তাঁর কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকা যাবে না।’ তিনি বলেন, যেসব নাম আসছে, তাঁদের সবার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অযোগ্য লোক আসা কাম্য নয়।
অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এবং নুজহাত চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ইসিতে স্থান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান।
গতকালের বৈঠকে ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ, গীতিকার ও সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, চিকিৎসক এম ইউ কবীর চৌধুরী প্রমুখ।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এর আগে জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেসব দল নাম দেয়নি, তাদের যেন আরেকবার সুযোগ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুধু রাজনৈতিক দলের যারা নাম দেয়নি, তারা আজ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদের ওয়েবসাইটে নাম দিতে পারবে।
তবে এই বিষয়ে বিএনপি আগের অবস্থানে আছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত রাতে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এমন প্রস্তাবের কথা শুনিনি। আমাদের কাছে লিখিত কিছু আসেনি। তবে এলেও নাম জমা দেওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা একটা প্রহসন।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব জানান, গতকাল পর্যন্ত ৩২৯ জনের নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল থেকে এসেছে ১৩৬ জনের। পেশাজীবী সংগঠন দিয়েছে ৪০টি নাম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসেছে ৯৯ জনের। ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজে নিজেকে প্রস্তাব করেছেন ৩৪ জন। এ ছাড়া বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় পাওয়া গেছে ২০ জনের নাম।
প্রস্তাবকারীদের নামসহ নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে কি না—এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘প্রস্তাবকারীর নাম প্রকাশের পরামর্শ এসেছে। তবে আমাদের কাছে ম্যাক্সিমাম সাজেশনস এসেছে যাতে প্রস্তাবকারীদের নাম না থাকে।’
কবে নাগাদ তালিকা চূড়ান্ত হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরশু দিন মিটিং আছে। তালিকাটা ফাইনাল হওয়ার পরে এখানে (জাজেস লাউঞ্জে) বিকেল সাড়ে চারটায় মিটিং। তারপর বাকি সব ঠিক করা হবে।’