প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম ভোট হচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে। এ জন্য এই নির্বাচনকে নতুন ইসির জন্য ‘পরীক্ষা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু প্রথম পরীক্ষাতেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে এই কমিশন।
প্রশ্ন তৈরি হয়েছে এই কারণে যে ‘কৌশলে’ নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ায় ইসি কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। তারপরও তিনি এলাকায় অবস্থান করেন। কিন্তু কমিশন কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। উল্টো সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল গত রোববার সংসদ সদস্যকে নিয়ে কমিশনের অসহায়ত্বের কথা বলেন। আর গতকাল সোমবার বিষয়টি নিয়ে দুই নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ও রাশেদা সুলতানা কুমিল্লায় সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন। তাঁরা বলেছেন, একজন সম্মানিত লোককে টেনেহিঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। এমনকি সরকারি সুবিধাভোগী কেউ কারও পক্ষে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে প্রতীয়মান হলে ইসি প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইসির হাতে যে ক্ষমতা আছে, তাতে যদি মনে করে কারও হস্তক্ষেপের কারণে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যাচ্ছে না, তাহলে সেই নির্বাচন স্থগিত করে দিতে পারে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের কমিশনের মেয়াদের শেষ সময়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগমুহূর্তে সাবেক এক মন্ত্রী সেখানে গিয়েছিলেন। তখন রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে ওই মন্ত্রীকে বলা হয়, তিনি যদি আর ঘণ্টাখানেক সেখানে থাকেন, তাহলে নির্বাচন স্থগিত করে দেওয়া হবে। তখন ওই মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে এলাকা ত্যাগ করেন।
এ রকম আরও কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন যদি এখন একজন সংসদ সদস্যকে বাগে আনতে না পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনের সময় যখন সব সংসদ সদস্য এলাকায় থাকবেন, জাঁদরেল মন্ত্রীরা থাকবেন, তখন সামলাবে কীভাবে?’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আগামীকাল বুধবার অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের অনুসারী আরফানুল হক রিফাত আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বহিষ্কার হওয়া বিএনপি নেতা ও বিদায়ী মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে রয়েছেন। আরেক স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক দলের কুমিল্লা মহানগর কমিটির সভাপতি ছিলেন। মোট মেয়র প্রার্থী পাঁচজন।
অভিযোগ ওঠে, সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন এলাকায় থেকে আরফানুল হকের পক্ষে নির্বাচনী কাজ করছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে এলাকা ছাড়তে চিঠি দিয়েছিল ইসি। তবে বাহাউদ্দিন বলেছেন, তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না। কোনো ধরনের আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন না।
‘নৌকা জিতবে শতভাগ নিশ্চিত।’আরফানুল হক, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী
এমন অবস্থায় এই নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য বাছাই করা প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্রিফ করতে গতকাল কুমিল্লায় যান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ও রাশেদা সুলতানা। কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মিলনায়তনে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আহসান হাবিব খান প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন কমিশন কুমিল্লায় একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে চায়।
পরে দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দুই কমিশনার। আহসান হাবিব খানের কাছে প্রশ্ন ছিল, কমিশনের চিঠির পরেও কী করে সিটি এলাকায় অবস্থান করছেন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন? জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত আপনি (বাহাউদ্দিন)। এই ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতা হয়ে আপনি নিজেই ব্যর্থ হলেন।’ তিনি বলেন, এরপরও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে নেবেন বাংলাদেশের মানুষ।
আরেক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘আইনি কাঠামো যেভাবে আছে, সেভাবে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। উনি (বাহাউদ্দিন) আইন মানেন না, আইনপ্রণেতা। আপনারা আমাদের ব্যর্থ বলেন কেন? একজন সম্মানিত লোককে টেনেহিঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়।’
তখন গণমাধ্যমকর্মীরা পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান, এতে ইসির (নির্বাচন কমিশনের) ‘ইজ্জত’ গেছে কি না? জবাবে রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘যিনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন, তাঁর ইজ্জত কী? উনি চলে গেলে ভালো করতেন। নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে কমিশনকে ব্যর্থ বলা ঠিক নয়।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রচারণার শেষ দিন ছিল গতকাল। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক শেষ দিনের প্রচারণা শেষে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌকা জিতবে শতভাগ নিশ্চিত।’
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মো. মনিরুল হক নগরের নানুয়াদিঘির পাড় এলাকার বাসায় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কেমন নির্বাচন করে, ভোটের দিন দেখব।’