২৪৯ জন নেতা অংশ নেন, বক্তব্য দেন ১১২ জন।
জামায়াত এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট করতে মত।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় কর্মপন্থা ঠিক করতে যাচ্ছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে ১০ থেকে ১২ দফার একটি রূপরেখার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সেটি চূড়ান্ত করতে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পাশাপাশি তাঁদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।
তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না, আর না নিলে আন্দোলনের কৌশল কী হবে, তা নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকেরা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। এ ছাড়া দুই রাজনৈতিক জোটের (২০ দল এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, সে বিষয়টিও এখনো ঠিক হয়নি।
বর্তমান সরকার এবং বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোটে অংশ না নিতে মত দিয়েছেন নেতারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে টানা তিন দিনের বৈঠকে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সবাই বর্তমান সরকার এবং বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিন দিনের বৈঠকে মোট ২৪৯ জন নেতা অংশ নেন, বক্তব্য দেন ১১২ জন। বৈঠকের সময় ছিল সাড়ে ১৬ ঘণ্টা। সবার বক্তব্যের মূল বিষয় হচ্ছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এবং বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোটে অংশ নিলে ফলাফল ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের মতোই হবে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যেতে হলে বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় (দলীয় সরকারের অধীনে নয়) পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেটি আদায় করার জন্য আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প তাঁরা দেখছেন না।
মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঠিক করতেই দলের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রথম দিন মঙ্গলবার দলের ভাইস চেয়ারম্যান,চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ, দ্বিতীয় দিনে যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সম্পাদক পদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। শেষ দিনে বৃহস্পতিবার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি লন্ডন থেকে বৈঠকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে এটি তারেক রহমানের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১০ থেকে ১২ দফার একটি রূপরেখার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সেটি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ও মতামত নেওয়া হচ্ছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব প্রথম আলোকে বলেন, গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে দলে নানা মত ছিল। এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তিন দিনের বৈঠকে এমন একজন নেতাও পাওয়া যায়নি, যিনি নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে অথবা মাঝামাঝি কোনো মত দিয়েছেন। একবাক্যে সবাই বলেছেন, এ সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচন নয়।
দলীয় সূত্র জানায়, তিন দিনের বৈঠকে মোটাদাগে পাঁচটি বিষয়ে বেশি মতামত এসেছে নেতাদের কাছ থেকে। এর মধ্যে শীর্ষে ছিল দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে না যাওয়া। এরপর ছিল দলকে ঐক্যবদ্ধ করার পরামর্শ। দল পুনর্গঠন নিয়ে ক্ষোভ, কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং জোট থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারেও মতামত আসে।
তিন দিনের বৈঠকে উপস্থিত থাকা ১০ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের বক্তব্যে মূল বিএনপির পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদ, শাজাহান ওমরসহ আরও অনেকে নিজ নিজ এলাকায় দল পুনর্গঠনের সময় তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করার বিষয়টি তোলেন। তাঁরা বলেন, বিভিন্ন এলাকার জ্যেষ্ঠ নেতাদের এড়িয়ে দল পুনর্গঠন করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে যে কমিটি দেওয়া হচ্ছে, তাতে নেতা–কর্মীদের একটি অংশকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে স্থানীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়া এই দল নিয়ে ভবিষ্যতে বড় ধরনের আন্দোলন বা দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি কতটা সফল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মূল বিএনপির সঙ্গে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দূরত্বের বিষয়টিও বৈঠকে তোলেন কোনো কোনো নেতা। প্রথম দিনের বৈঠকে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান। তিনি বলেন, গত ১৭ আগস্ট চন্দ্রিমা উদ্যানে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে পুলিশের আক্রমণের মুখে তিনি ছাত্রদলের এক নেতাকে ফোন করে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। জবাবে ওই ছাত্রদল নেতা বলেছেন, তাঁরা কেন বিএনপির দায়িত্ব নেবেন।
তিন দিনের এ বৈঠকে একাধিক নেতা কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দলের নীতিনির্ধারকদের পিছিয়ে থাকা নিয়েও কথা বলেন। এ ছাড়া বৈঠকে ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী ও গত সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন নিয়েও কথা বলেছেন কয়েকজন নেতা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১০ জন নেতা জামায়াত ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট করতে মত দেন। এর মধ্যে তিনজন নেতা জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শ দেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিনের এই বৈঠকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাতে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে মতামত এসেছে। শনিবার (আজ) স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব পর্যালোচনা করা হবে। এরপর হয়তো আরও সভা করতে হবে। তারপর গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো হবে।
জানা গেছে, প্রথম দিনের বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য বলেন, গণমাধ্যমে এসেছে জোটের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, ২০-দলীয় জোট আছে বললেও ঠিক, নেই বললেও ঠিক। তাঁর মত, এ ধরনের কথাগুলো আসছে হতাশা থেকে। এ ধরনের অস্পষ্টতা দ্রুত কাটাতে হবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন এবং আন্দোলন প্রশ্নে আমরা একটি রূপরেখা তৈরির কাজ করছি, মাঠের চাহিদা অনুযায়ী একটি সূচি তৈরির চেষ্টা করছি। এখন বৈঠক করে মতামত নেওয়া হচ্ছে, যাতে চূড়ান্ত রূপরেখায় তাঁদের মতের প্রতিফলন থাকে। যাতে কেউ এমনটি বলতে না পারেন যে কেন্দ্র থেকে তাঁদের ওপর কিছু চাপিয়ে দিয়েছে।’
এর আগে দলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পৃথকভাবে সভা করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সব পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে এমন বৈঠক এই প্রথম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, তিন দিনের এই বৈঠকের দুটি দিক আছে। এর একটি হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে হঠাৎ করে যে নির্বাচনী বাতাস দেওয়া হয়েছে, তার বিপরীতে এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিএনপিও দলীয় প্রস্তুতির বিষয়টি জানান দিয়েছে। অন্যটি হচ্ছে দলের ভেতরে–বাইরে তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন আছে, সে বিষয়ে একটি বার্তা দেওয়া। তা হচ্ছে দল তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত।
দলীয় সূত্র জানায়, রাজনৈতিক কর্মপন্থা চূড়ান্ত করতে শিগগিরই দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, জেলা কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং পেশাজীবীদের সঙ্গেও মতবিনিময় করবে বিএনপি। যদিও তিন দিনের বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি বিএনপি। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে নেতাদের কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতাদের বলা হয়েছে, যা বলার দলের মহাসচিব বলবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির নিশ্চুপ অবস্থান দলের তরুণ নেতারা, এমনকি সাধারণ মানুষজনও পছন্দ করছেন না। আমার মনে হয়, তাঁদের চাপেই বিএনপি এখন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। যতটুকু শুনেছি, বয়স্ক নেতারা কিছুটা সমঝোতামুখী, কিন্তু তরুণ নেতারা এর বিরুদ্ধে। তাঁরা কোনো সমঝোতার নির্বাচনে যেতে চান না। এখন তৃণমূলের নেতাদের চাপেই এসব বৈঠক হচ্ছে বলে মনে হয়।’