দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কিছু বলবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘আইন ও সাংবিধানিক বিধি অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য শপথ নিয়েছি। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপার। তাঁরা তাঁদের মতো আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
আজ বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ শেষে সিইসি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংলাপে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ ২২ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শিক্ষাবিদসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দুই দফায় সংলাপ করে ইসি।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন থেকেই সংলাপ করা হচ্ছে। অনেকে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন, যেগুলো লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। সংলাপে যেসব বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে পারলে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করে কাজে এগিয়ে যেতে পারব।’
সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এখনো এ বিষয়ে কিছু বলার পরিস্থিতি হয়নি। অংশগ্রহণমূলক, সুন্দর নির্বাচনের জন্য আমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করব। নির্বাচনে যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো সংলাপে আলোচনা হয়েছে, তা আমরা শুনেছি।’
সরকার না চাইলে ভালো নির্বাচন করা কঠিন বলে মন্তব্য করেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান। তিনি বলেন, কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নাকি নির্দলীয় বা জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এ বিষয়ে ইসি আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে।
যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, জনগণের আস্থা অর্জন, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ জরুরি। সব কাজ করার পরেও জনগণ ভোট না দিতে এলে নির্বাচন বিতর্কিত হয়ে যাবে। ভোট জনগণের আমানত। এই ভোট যখন অন্য কেউ দিয়ে দেয়, তখন ভোটাররা ক্ষুব্ধ হন, ব্যথিত হন। রাজনৈতিক, পেশি ও অর্থশক্তি যেন ইসিকে দমিয়ে না রাখতে পারে।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান বলেন, সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তা গ্রহণযোগ্য হওয়ার সুযোগ থাকে। ইসি চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।
নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, নির্বাচন নিয়ে মানুষের আস্থা কমে গেছে। ইসির মূল দায়িত্ব আস্থা ফিরিয়ে আনা। ইসির হারানোর কিছু নেই। মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ আছে। নির্বাচনের সময় নির্বাহী বিভাগ ইসির অধীনে কাজ করবে, ইসি সদিচ্ছা থাকলে এটি করা সম্ভব।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অবশ্যই বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, নানা ধরনের রাজনৈতিক চাপ আসবে, সেগুলো মোকাবিলা করতে পারলে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। দলগুলোর সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং।
ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ইসির প্রধান দায়িত্ব তাদের হারানো ভাবমূর্তি ফেরানো। অতীতে দেখা গেছে, ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চেষ্টাও করেনি। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছেন। এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য বাইরের দেশের দূতিয়ালি করা লজ্জাজনক।
পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন, সেটি আশা করি না। তিনি প্রতিটি বিভাগে পৃথক দিনে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, আগের নির্বাচন কমিশনগুলো সংলাপ করেছে, সেগুলোর ফলাফল সুখকর না। গত দুটি ইসি কী কী ভুল করেছে, সেগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। ভোটারদের পাহারাদার ইসি। ইসি কী এই ১১–১২ কোটি ভোটারের ভোট পাহারা দিতে পারবে? সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধাগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলো সমাধান করতে হবে। তিনি জেলা প্রশাসকদের বদলে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
দ্য ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সংলাপের মাধ্যমে ইসি জনগণের যতটা আস্থা অর্জন করবে, তার থেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বেশি আস্থা অর্জন করতে পারবেন। সব দলের অংশগ্রহণ করার মতো নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে হবে ইসিকে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে হয়। এই কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিতে পারলে জাতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, সাংবাদিকদের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে নানা বাধা এসেছে। একসময় নির্বাচন পর্যবেক্ষণব্যবস্থা ভালো ছিল। স্বার্থের দ্বন্দ্বে তা সংকুচিত হয়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ অবাধ করলে বিতর্কিত অনেক বিষয় সামনে আসবে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক এনাম আহমেদ বলেন, বিভিন্ন আইনের দ্বারা মিডিয়া বাঁধা। নির্বাচনের সময় এসব আইন সাংবাদিকদের জন্য শিথিল করা হবে কি না, এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ইসি জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহবুব কামাল। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। তবে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে না—এটি ধরেই ইসিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এগোতে হবে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে বেশ কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে। এসব নির্বাচন দিয়ে ইসিকে আস্থা অর্জন করতে হবে। সামনের নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু করতে বিপদ, ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক বিভু রঞ্জন সরকার, অজয় দাস গুপ্ত, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক, বাংলাদেশ জার্নালের সম্পাদক শাহজাহান সরদার, দৈনিক আমার সংবাদ সম্পাদক হাশেম রেজা, মানবকণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দুলাল আহমেদ চৌধুরী, দ্য ডেইলি অবজারভারের অনলাইন ইনচার্জ কাজী আবদুল হান্নান, প্রতিদিনের সংবাদ সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম, দৈনিক ভোরের ডাক সম্পাদক কে এম বেলায়েত হোসেন।