২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকারি সংস্থাগুলো বলেছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুলে যাওয়া চোখ বন্ধ হয়ে গেছে।
সাড়ে তিন বছর আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত কমিটি ৩০টি নির্দেশনা জারি করে। এসব নির্দেশনার অধিকাংশই ছিল সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার রুটিন দায়িত্ব এবং দ্রুত কার্যকর করার মতো বিষয়। কিন্তু নির্দেশনাগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। এত দিন পর গাড়িচাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবারও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম নিহত হন। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছিল। টানা নয় দিন রাজপথে আন্দোলনের পর সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। একাধিক সভা করার পরে ২০১৮ সালের আগস্টে কমিটি ৩০টি সিদ্ধান্ত জানায়। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব নির্দেশনার অধিকাংশই দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব ছিল। যেমন বাস থেকে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধ করা, চলাচলের সময় অধিকাংশ বাসের দরজা বন্ধ রাখা এবং পদচারী–সেতু দিয়ে সড়ক পারাপার নিশ্চিত করা। অবশ্য নির্দেশনা মেনে আবদুল্লাহপুর থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত নয়টি ইউটার্ন খুলে দেওয়া হয়েছে। আর মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী দুজনকেই হেলমেট ব্যবহার অনেকটাই নিশ্চিত করা গেছে। এ বিষয়ে পুলিশ যথেষ্ট তৎপর।
ওই সময় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি সংস্থাগুলো বলেছিল, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এত দিন পর নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর সড়ক পরিস্থিতি দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুলে যাওয়া চোখ বন্ধ হয়ে গেছে।
গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহন করা গাড়ির চাপায় নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর দুদিন ধরে রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা। সাড়ে তিন বছর আগে করা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের তোলা দাবিগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ার কথা তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলছেন, কয়েক বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সড়ক সবার জন্য নিরাপদ হবে। কিন্তু আগের দাবিগুলোর অধিকাংশই পূরণ হয়নি।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর সড়কে দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিহত-আহত হচ্ছেন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কয়েক সপ্তাহ নিরাপদ সড়ক নিয়ে আলোচনা হয়, তারপর সবকিছু আগের মতোই হয়ে যায়। শুধু নির্দেশনা জারি করেই দায়িত্ব শেষ করলে হয় না, এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্বও সরকারের।
রাজধানীর ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত প্রায় ২১ কিলোমিটার পথে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলক বাস রুট রেশনালাইজেশন শুরু হবে। তবে কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, বাস চালানো শুরুর প্রস্তুতি শেষ করা যায়নি
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর দুদিন রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় মারা গেছেন দুজন। দুটি ঘটনাতেই গাড়িচালকের গাফিলতি ছিল। অথচ ২০১৮ সালেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কমিটি নির্দেশনা দিয়েছিল, ঢাকায় অবস্থিত সব সংস্থার আওতাধীন যানবাহন এবং কর্মচারীরা যেন ট্রাফিক আইন মেনে চলেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সংস্থার প্রধানদের বিষয়টি নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিবহন পুল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সাড়ে তিন বছরে সংস্থার চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার বিষয়ে আলাদা করে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বরং সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চালকদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে বেপরোয়া যান চালানোর অভিযোগ পাওয়া যায়।
রাজধানীতে বেপরোয়া বাস চালানো ও রেষারেষি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কমিটি দ্রুততম সময়ে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালু করার নির্দেশ দেয়। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে লক্কড়ঝক্কড় বাস তুলে সহজ শর্তের ঋণে নতুন বাস নামানো। পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির অধীনে বাস চালানো, যাতে মালিকেরা বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পান। এখন পর্যন্ত রাজধানীর কোনো পথেই এ ব্যবস্থা চালু হয়নি।
চার বছরে সরকারের গঠিত বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি এখন পর্যন্ত ১৮টি সভা করেছে। কমিটি বলছে, কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত কোম্পানির মাধ্যমে বাস চলাচলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ১ এপ্রিল ও ৭ সেপ্টেম্বর দুই দফা এই পথে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েও চালু হয়নি।
সর্বশেষ কমিটির ১৮তম সভায় ঘোষণা দেওয়া হয়, ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত প্রায় ২১ কিলোমিটার পথে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলক বাস রুট রেশনালাইজেশন শুরু হবে। তবে কমিটির একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বাস চালানো শুরুর প্রস্তুতি শেষ করা যায়নি।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের আওতাধীন সড়কের যানবাহন চলাচল নজরদারির নির্দেশনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কমিটি। তবে সিটি করপোরেশন থেকে কাউন্সিলরদের নিজ এলাকার সড়কের যানবাহন চলাচল নজরদারির বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
ঢাকার দুই সিটির দুজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের যানবাহন চলাচল নজরদারি করার মতো কাউন্সিলরদের কোনো লোকবল নেই। এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু জায়গায় সিসিটিভি বসানো হয়েছে। বড়জোর এলাকার ভেতরের কোনো সড়কে কখনো বেশি যানজট তৈরি হলে সেটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
সড়কে পদচারী–সেতু আছে, এমন জায়গায় দুই পাশের ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিছু এলাকায় সড়ক বিভাজক উঁচু করে পথচারী পারাপার বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। আবার কিছু এলাকায় পদচারী–সেতুর কাছেই গাড়ি ইউটার্ন নেওয়ার জায়গা, ফলে সেগুলো বন্ধ না করায় পথচারীরা নিচ দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার হচ্ছেন। পদচারী–সেতুগুলোর পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বাতি ও সিসিটিভি স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কমিটি। ঢাকার সব পদচারী–সেতুতে এখনো সন্ধ্যার পরে বাতি জ্বলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে নানামুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বেশ কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছে। কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নে অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালুর মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে চেষ্টা করা হচ্ছে।
সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে জনগণের ভোগান্তি কমাতে বেশ কিছু নির্দেশনা ছিল। এর মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সড়ক খোঁড়া, সংস্থাগুলোর নিজস্ব ব্যয়ে সড়ক মেরামতের মতো বিষয় রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯’ চূড়ান্ত করেছে। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ রাজধানীতে সেবাদানকারী সংস্থাগুলো নীতিমালা না মেনেই সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া এই নীতিমালা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে মনে করেন নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আকতার মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংস্থাগুলো যেন তাদের দেওয়া বার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
পান্থকুঞ্জ পার্কটি রাজধানীর ব্যস্ততম সোনারগাঁও মোড়ের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। ত্রিভুজাকৃতির এই পার্ক ক্লান্ত পথচারীর বিশ্রামের জায়গা ছিল। ২০১৮ সালে পার্কটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা ছিল, ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পান্থকুঞ্জ পার্কটি জনসাধারণের ব্যবহার উপযোগী করতে হবে।
কিন্তু সাড়ে তিন বছর পার হলেও এখনো পার্কটি জনসাধারণকে ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না। চারদিকে টিন দিয়ে পার্কটি ঘেরা। পুরো পার্ক জঙ্গল হয়ে গেছে। দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কিছু অংশ পার্কে বসতে পারে, বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা চলছে।
ঢাকা শহরের ১৪০টি স্থানে বাস থামা এবং যাত্রী ওঠা-নামা নিশ্চিত করার নির্দেশনা ছিল। এসব স্থান চিহ্নিত করার পাশাপাশি যাত্রীছাউনির ব্যবস্থার করার কথাও ছিল। আরেকটি নির্দেশনা ছিল চলাচলের সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখতে হবে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শ্যামলী, সার্ক ফোয়ারা, শাহবাগ, মহাখালী, গুলিস্তান মোড় ঘুরে দেখা যায়, বাস থেকে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধ হয়নি। বেশির ভাগ চলন্ত বাসের দরজাও খোলা। তবে কমিটির নির্দেশনা মেনে বিভিন্ন এলাকায় বাস থামার জায়গা চিহ্নিত করে ছোট বোর্ডে নির্দেশনা লাগিয়েছিল ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। যার অধিকাংশই এখন দেখা যায় না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় বলা ছিল, গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর এবং মুঠোফোন নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে। গতকাল অন্তত ১০টি বাসে উঠে দেখা যায়, কোনো বাসেই চালকের ছবিসহ লাইসেন্স, মুঠোফোন নম্বর দৃশ্যমান জায়গায় প্রদর্শন করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এসব নির্দেশনা যাদের বাস্তবায়ন করার কথা, সেসব দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা একেবারেই উদাসীন। নিরাপদ সড়কের মতো জনস্বার্থের বিষয়গুলোকে তারা উপেক্ষা করছে। পরিবহনমালিকদের একচেটিয়া প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের গাফিলতি থাকলে তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।