৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। মস্কোতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর সঙ্গে জরুরি সাক্ষাতের জন্য ইসলামাবাদ থেকে ছুটে এসেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খান। এর আগের মাসে, অর্থাৎ আগস্টে দিল্লিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। ব্যাপারটি পাকিস্তানের জন্য ‘বোমা ফাটানোর মতো ঘটনা’। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পত্রবাহক হিসেবে সুলতান খান গ্রোমিকোর কাছে এই চুক্তির ব্যাখ্যা চাইলেন।
ঝানু কূটনীতিক গ্রোমিকো, মেপে কথা বলা তাঁর অভ্যাস। তিনি জানান, ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির উদ্দেশ্য উপমহাদেশে শান্তিকে সংহত করা। এই চুক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নির্দেশিত নয়, কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক ব্যবস্থা গৃহীত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরব থাকবে না। বাংলাদেশে অব্যাহত সামরিক সংঘাতের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ছাড়া সেখানে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। রাজনৈতিক সমঝোতার পথে এগোতে হবে, আর সে জন্য বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে।
আন্দ্রেই গ্রোমিকো ও সুলতান খানের এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মস্কোতে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত একসময়ের নামজাদা ক্রিকেট ভাষ্যকার জামশেদ মার্কার। তিনি স্মরণ করেছেন, আলোচনার একপর্যায়ে দোভাষীর মাধ্যমে গ্রোমিকো বললেন, ‘দয়া করে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না, যা চুক্তিবদ্ধ কোনো দেশের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পূরণে বাধ্য করে।’
এই পর্যায়ে গ্রোমিকো দোভাষীর অনুবাদ শুধরে বললেন, ‘আমি প্লিজ বা দয়া করে কথাটা ব্যবহার করিনি।’ জামশেদ মার্কার গ্রোমিকোর এই ব্যবহার অকূটনীতিক সুলভ বলে বর্ণনা করেছেন, যদিও সেদিন তাঁর বা সুলতান খান কারও বুঝতে বাকি ছিল না বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েত অবস্থান কী।
যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলছি, পৃথিবীর মানচিত্রে সে নামের কোনো দেশ এখন আর নেই। ১৯৯১ সালের পর দেশটি ১৫ টুকরায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে কঠিন দুঃসময়ে ভারত ছাড়া আর হাতে গোনা যে কয়টি দেশ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেই অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অন্যতম।
বস্তুত, ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম প্রকাশ্যে সমালোচনা করে সরকারি বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। ২ এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত ও ‘নিষ্পেষণ’ বন্ধের পাশাপাশি সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হলো। গোপনে রাষ্ট্রদূত অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে নয়, সোভিয়েত বার্তা সংস্থার মাধ্যমে পদগোর্নির বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়, যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ প্রশ্নে কার্যত একটি প্রকাশ্য ‘পক্ষপাতপূর্ণ’ অবস্থান গ্রহণ করে।
মস্কো দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষায় আগ্রহী ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তাসখন্দ বৈঠকের আহ্বায়ক হিসেবে নিজের নিরপেক্ষতা সে উভয় দেশের কাছে কমবেশি প্রমাণে সক্ষম হয়েছিল। এই অবস্থায় পাকিস্তান তার পূর্বাংশের ঘটনাবলি নিজের ‘অভ্যন্তরীণ’ দাবি করা সত্ত্বেও মস্কোর সমালোচনাপূর্ণ অবস্থান বাংলাদেশ প্রশ্নে তার ‘পক্ষপাতিত্ব’ ইসলামাবাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
পাকিস্তান যে মস্কোর এই অবস্থানে খুশি হয়নি, ৫ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পাঠানো উত্তরে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সোভিয়েত বক্তব্য ‘দুমুখো’ বর্ণনা করে ইয়াহিয়া তাঁর চিঠিতে কিছুটা অকূটনৈতিক ভাষায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিলেন, নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান সে একাই করতে সক্ষম, এ ব্যাপারে বাইরের হস্তক্ষেপ অভিপ্রেত নয়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা প্রশ্নে এই সোভিয়েত অবস্থানের পাশে অপর দুই পরাশক্তি, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিক্রিয়া স্মরণ করলে তার গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চীনের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের ‘দ্বার উন্মুক্ত’ করতে ইয়াহিয়া দূতিয়ালি করছেন, এই কারণে নিজ দেশের কূটনীতিকদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন গণহত্যা প্রশ্নে নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া ছিল, বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
অন্যদিকে চীন প্রাথমিক নীরবতা কাটিয়ে ৯ এপ্রিল ইয়াহিয়াকে পাঠানো এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই জানান, পাকিস্তান ও তার জনগণকে নিজেদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে চীন তাদের পাশে থাকবে।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে মস্কো যে তার প্রতি সমর্থন জানায়, তা নয়। গণহত্যা সত্ত্বেও এই সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব, মস্কো এই নীতি দ্বারাই পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনের প্রশ্নে প্রথম সোভিয়েত সম্মতি মেলে জুনের শেষে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ শিংয়ের মস্কো সফরের সময়। এই সময় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘পূর্ব বাংলায় যুদ্ধরত গেরিলা বাহিনীর প্রতি’ তাদের সমর্থনের প্রশ্নে সম্মত হয়।
অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যায় জুলাই মাসের মাঝামাঝি। এক আকস্মিক ঘোষণায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জানান, তিনি পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭২-এর মে মাসে চীন সরকারের আমন্ত্রণে পিকিং সফরে আসছেন। এই ঘোষণার পরই জানা গেল, পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ইতিমধ্যে পিকিং ঘুরে এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে এসেছেন। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়। কারণ, এই আঁতাত মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দুই পরাশক্তির নতুন মেরুকরণ হলেও বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা উভয়েই পাকিস্তানের নিকট মিত্র। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ৯ আগস্ট দিল্লিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ২০ বছর স্থায়ী ‘শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এতে বলা হলো, চুক্তিবদ্ধ দেশের কেউ যদি সামরিক হামলার মুখোমুখি হয়, তাহলে অপর দেশ তার পাশে থাকবে।
এই চুক্তি ভারতীয় পক্ষকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধে সাহস জোগায়, তাতে সন্দেহ নেই। এই সময় থেকেই মস্কো অনেক খোলামেলাভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করা শুরু করে।
মৈত্রী চুক্তির আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্বীকৃতির পূর্বশর্ত হিসেবে মস্কো বাংলাদেশে যুদ্ধরত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সমন্বয়ে একটি ঐক্য জোট গঠনের ওপর জোর দেয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠিত হয়। ক্ষণস্থায়ী এ উপদেষ্টা কমিটির অন্তর্ভুক্ত হন আওয়ামী লীগের দুজন প্রতিনিধি তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মোশতাক আহমদ, মস্কোপন্থী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মণি সিংহ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মুজাফ্ফর আহমদ, ন্যাপ (ভাসানী) গ্রুপের প্রধান মাওলানা ভাসানী ও বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর। এর আগপর্যন্ত সোভিয়েত পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে চিত্রিত হয়নি। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে মস্কোতে ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে মুখোমুখি আলোচনায় সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উপাদান রয়েছে।’
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। এর অব্যবহিত পরে এক ভিন্ন রকমের যুদ্ধ শুরু হয় ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভক্তি ঠেকানো অসম্ভব, এই দুর্ভাবনা নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মস্ত শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের ভরাডুবি ঠেকানোর সম্ভাব্য পথ হিসেবে তাঁরা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি অর্জনে অগ্রসর হলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই রণকৌশলে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর—এই সময়ে নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশ প্রশ্নে দফায় দফায় জরুরি বৈঠকে মিলিত হলেও কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রেসিডেন্ট নিক্সন দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে প্রেরণের নির্দেশ দেন। বলা হলো, পূর্ব পাকিস্তানে আটকে পড়া মার্কিন নাগরিক অপসারণে সাহায্য করতে তাদের পাঠানো হচ্ছে। এই বহরের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিশ্বের বৃহত্তম আণবিক যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজ। ঠিক একই সময়ে ভ্লাদিভস্তক থেকে একটি সোভিয়েত বিমানবিধ্বংসী নৌবহর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। ফলে বাংলাদেশ প্রশ্নে দুই পরাশক্তির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়।
ভারত মহাসাগর এলাকায় আগে থেকেই তিনটি সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ টহলরত ছিল। সোভিয়েত নৌবহরের অন্তর্গত ছিল ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপের জন্য আণবিক বোমা সজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র, একটি মাইন সুইপার ও একটি নৌ-তেলযান। ভারত মহাসাগর থেকে চীন সাগর পর্যন্ত মোট ৫০০ মাইল দীর্ঘ সমুদ্র এলাকায় এই জাহাজগুলো নিয়মিত টহল দিত। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম নৌবহরটি তাদের ঘাঁটি ভ্লাদিভস্তকে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু মার্কিন পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে সোভিয়েত নৌকমান্ড তাদের সমুদ্র এলাকায় টহল অব্যাহত রাখতে বলেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ভারত মহাসাগর এলাকায় মোট সোভিয়েত নৌযানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬।
সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়েছে, এই খবর পেয়েই পাকিস্তানি জেনারেলরা প্রবল উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান নিয়াজি সদম্ভে জানান, আত্মসমর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে অবশিষ্ট মার্কিন নাগরিককে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরও সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যথেষ্ট দূরে থাকলেও সোভিয়েত নৌবহরও একই সমুদ্রপথে এগিয়ে আসছিল। সৌভাগ্যবশত এই দুই আণবিক অস্ত্রবাহী নৌবহর একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার আগেই ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে বসে।
কোনো কোনো মহলে, এমনকি বাংলাদেশি লেখকদের মধ্যেও ১৯৭১-এ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা অভিন্ন চশমা দিয়ে দেখার প্রবণতা রয়েছে। তাঁরা সবাই নিজেদের জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। এসব লেখক-বুদ্ধিজীবী ভুলে যান যে একাত্তরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র খোলামেলাভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তারা সম্ভবত এ কথাও ভুলে যান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অস্ত্রেই পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যায় মেতে ওঠে।
অন্যদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসৃত নীতি, ডাচ বিশেষজ্ঞ ভিলেন ভ্যান কোমেনাডের বিবেচনায়, শুধু কৌশলগত জাতীয় স্বার্থ দ্বারা নয়, কিছু নীতিগত বিবেচনা দ্বারাও পরিচালিত হয়েছিল। ভারত ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের, রুশ বিপ্লবের পর যেসব দেশের মানুষ তাকে স্বাগত জানায়, ভারত তাদের অন্যতম। জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা, অধিকাংশ ভারতীয় নেতা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। অন্য কথায়, এই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে রাজনীতির বাইরে একটি ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের প্রতি সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি মুখ্যত ভারতের প্রতি এই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবেরই প্রতিফলন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের জাতিসমূহের মুক্তি আন্দোলনের অন্তর্গত, মস্কোর কাছ থেকে এমন স্বীকৃতি পাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী একটি নবতর পর্যায়ে উন্নীত হয়। এই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করুক, মস্কো যে তা মনেপ্রাণে চেয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কের সময়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের চেষ্টাই ছিল যেকোনো মূল্যে যুদ্ধবিরতি অর্জন ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ। এই কৌশল বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন সুদূরপরাহত না হোক, তা যে বিলম্বিত হতো, সে কথায় সন্দেহ নেই। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ক্ষমতার অধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক সমালোচনা উপেক্ষা করে যুদ্ধবিরতির সব প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ ছিল মার্কিন হুমকির জবাবে বঙ্গোপসাগরে একটি পাল্টা আণবিক নৌবহর প্রেরণ। বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে জেনেও মস্কো এই সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতকে সে আশ্বাস দিয়েছিল, মার্কিন ও চীনা হামলার মুখে সে তাকে একলা ফেলে রাখবে না। এই আশ্বাস বাংলাদেশের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
পেছনে তাকিয়ে এখন এ কথা অবশ্যই বলা যায়, একাত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে দেওয়া সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে।