চার দশক পার করা বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নানা হিসাব-নিকাশে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে পড়েছেন।
নির্বাচনের প্রস্তুতি, নাকি আন্দোলন। জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব, না সখ্য। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নীতি কী হবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিষয় এখনো স্পষ্ট নয় বিএনপির রাজনৈতিক নীতি-কৌশলে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি এখন অনেকটা দিশাহীন অবস্থার মধ্যে আছে।
আজ ১ সেপ্টেম্বর, বিএনপির ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। চার দশক পার করা দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নানা হিসাব-নিকাশে বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে পড়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, রাজনীতিতে বিএনপি এখন বিশেষ ভূমিকায় নেই। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের দিকটি এখনো স্পষ্ট নয়। দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও কাটেনি। এর মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই নির্বাচন হওয়ার কথা। তখন বিএনপির বয়স হবে ৪৫–এর বেশি। কিন্তু ওই নির্বাচনের জন্য বিএনপি কতটা প্রস্তুত, সে প্রশ্ন উঠেছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
পুনর্গঠন, অসন্তোষ
বহুদিন ধরে বিএনপিতে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ চলছে। পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলেরও পুনর্গঠন চলছে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এই পুনর্গঠন হচ্ছে, তা দলকে সংগঠিত করার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকে অভিযোগ তুলছেন। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত গত আগস্ট মাসে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহস্বেচ্ছাসেবা–বিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জামানসহ সিলেটে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের দেড় শতাধিক নেতার পদত্যাগ। স্বেচ্ছাসেবক দলের সিলেটে জেলা ও মহানগর কমিটিতে ‘ত্যাগীরা মূল্যায়ন না পাওয়ার’ অভিযোগ তুলে এই পদত্যাগের ঘটনা ঘটে।
বিএনপির সূত্র জানায়, দলে শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনায় গঠিত একাধিক প্রতিনিধিদল এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত। তারা এলাকায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে কমিটি করছে। কিন্তু এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এত কিছুর মধ্যেও বিএনপির বড় সাফল্য হচ্ছে, বিএনপি ভাঙেনি। ১৯৮১ সালের পর বিএনপি ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপিকে ভাঙার জন্য দুটি কমিটিও করে দিয়েছিল, কিন্তু পারেনি।মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি
দলের নেতারা বলছেন, একটি রাজনৈতিক দলের কমিটি গঠনে তিনটি পন্থা হতে পারে। প্রথমত, সম্মেলনের মাধ্যমে ভোটাভুটি করে। সেটা না হলে এলাকায় দলের প্রতিষ্ঠিত এক বা একাধিক নেতার অভিভাবকত্বে কমিটি হতে পারে। সেটাও সম্ভব না হলে শীর্ষ নেতৃত্বের গোপন জরিপেও কমিটি হতে পারে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় কমিটি দেওয়া হচ্ছে, তাতে না হচ্ছে তৃণমূলে গণতন্ত্র চর্চা, না এলাকায় দলের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের অভিভাবককে কেন্দ্র করে কমিটি হচ্ছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে নিয়োগকৃত প্রতিনিধিদল এলাকায় এলাকায় গিয়ে নেতৃত্ব ঠিক করে দিচ্ছেন। এটা করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসততা ও অনৈতিকতার অভিযোগ উঠছে, ফলে একটা অংশের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে এলাকায় অভিভাবক পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের গুরুত্বহীন মনে করছেন। যদিও এ বিষয়ে নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সাংসদ প্রথম আলোকে বলেন, সমস্যা হচ্ছে কমিটি দেওয়ার সময় নিয়োগকৃত নেতারা শীর্ষ নেতৃত্বের নাম ব্যবহার করছেন। ফলে এক পক্ষ ভাবছে, শীর্ষ নেতৃত্বের পছন্দে তিনি নেতা হয়েছেন, অন্যরা মনে করছেন শীর্ষ নেতৃত্বের কারণে তিনি বাদ পড়েছেন। এটা দলের জন্য ক্ষতিকর প্রক্রিয়া।
অবশ্য এই প্রক্রিয়াকে সমর্থনকারীরা বলছেন, দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শীর্ষ নেতৃত্ব এই কৌশল নিয়েছেন।
আন্দোলন, না নির্বাচন
নির্বাচন নাকি আন্দোলন—কোন পথের ছক কষছে বিএনপি। কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের কাছেও এ তথ্য অজানা।
দলের সাংগঠনিক বিষয়ে ভালো খোঁজ রাখেন উচ্চপর্যায়ের এমন এক নেতার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বর্তমানে মাঠপর্যায়ে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর যে কমিটি দেওয়া হচ্ছে, তাতে তাঁর মনে হয়েছে এর লক্ষ্য নির্বাচন, আন্দোলন নয়।
কিন্তু নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ দলের এ ধরনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে একমত নয়। তাঁরা মনে করেন, বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়। সেটা বর্তমান সরকারের অধীনে সম্ভব নয়। তাই দলকে প্রস্তুত করতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ের আন্দোলনের জন্য, এরপর নির্বাচনের প্রশ্ন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন নিশ্চিতভাবে আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার আন্দোলন। এর লক্ষ্য পক্ষপাতহীন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করা।’
তবে প্রশ্ন, আন্দোলন করে সরকারকে যে সরানো যাবে বা সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ে বাধ্য করা যাবে, এর নিশ্চয়তা কী? এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির ওই নেতা বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত করেই সরকারকে সরাতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। যদি গণ-আন্দোলনে বিএনপি আবারও ব্যর্থ হয়, তা হতে পারে। বিএনপির হারানোর আর কী আছে। বিএনপি ব্যর্থ হলে কর্তৃত্ববাদী শাসন আরও কিছুকাল দীর্ঘায়িত হবে।’
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত আছে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীন আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার। কিন্তু এ লক্ষ্যে আন্দোলন এবং নির্বাচন—কোনোটিরই প্রস্তুতি নেই বিএনপিতে। এমনকি গত তিনটি নির্বাচনের বিষয়ে দলের এমন কোনো গবেষণা বা পর্যালোচনা নেই, যার নিরিখে আগামীতে আন্দোলন বা নির্বাচনে সফল হওয়ার মতো কৌশল নিতে পারে। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে সরকারি দল কী ধরনের কৌশল নিতে পারে, তা-ও আন্দাজ করতে পারছেন না বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
দিগ্ভ্রান্ত বিএনপি
বিএনপির ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, প্রতিষ্ঠাকালে চীন, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য শক্তির সঙ্গে বিশেষ মৈত্রীর সুবিধা ভোগ করত বিএনপি। সে পরিস্থিতি এখন আর নেই; বরং ক্ষমতায় থাকতে নানা ঘটনায় বন্ধুসুলভ শক্তিগুলোর কারও কারও সঙ্গে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে, যা এখনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক স্থাপনে কোনো উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়।
যদিও এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে যে দূরত্ব হয়েছে, এটি নির্ধারিত হয়েছে কীভাবে? যেকোনো সরকারের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়। এমনকি সে সামরিক সরকার হলেও। আমেরিকা তো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক চরম বৈরী। এর পরেও তো তাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে।’
গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যেই আলোচনা আছে যে বিএনপির দিক থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দিকটা এখনো স্পষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের কথা উল্লেখ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোদির সফর নিয়ে বিএনপির অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। নেতাদের কথাবার্তায় প্রকাশ পায়, এ সফর তাঁদের পছন্দ হয়নি। কিন্তু দলীয়ভাবে কোনো অবস্থানও ছিল না। এই নেতা মনে করেন, বিএনপিকে বাস্তবতা মেনে অবস্থান ঠিক করতে হবে। কারণ, প্রতিষ্ঠালগ্নে স্নায়ুযুদ্ধের সময় রুশ-ভারতের আন্তর্জাতিক মেরুকরণের বাইরের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিকে পাশে পেয়েছিল বিএনপি। এখন তা নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, ‘তখন বিশ্ব প্রেক্ষাপট ছিল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। এখন গ্রে হয়ে গেছে।’ যদিও বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির প্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির সঙ্গে কারও দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এটা ঠিক নয়; বরং এই সরকারের প্রহসনের নির্বাচন এখন পর্যন্ত কেউ গ্রহণ করেনি। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, দুনীতির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সবাই প্রকাশ্যে কথা বলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর জঙ্গিবাদ দমনে আন্তর্জাতিকভাবে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়, বিএনপি তার সঙ্গে চলতে পারেনি। কারণ, জামায়াতকে সঙ্গে রেখে ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার চারদলীয় জোট সরকার যখন ক্ষমতায় বসে, তখন জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক জোট হয়। ওই সময় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে, অনেক নৃশংস হামলা হয়। বিএনপির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ওঠে তখন। পাশাপাশি জামায়াতকে নিয়ে বিতর্ক থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে বিএনপির ওপর। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীর মতে, জামায়াতে ইসলামীকে চারদলীয় জোট সরকারে রাখার কারণে বিএনপি আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, জামায়াতকে সঙ্গে রেখে বিএনপি যে ভুল করেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা উত্তম। তাতে নেতিবাচক ধারণাটা কেটে যাবে।’
হাতছাড়া ধর্মীয় মূল্যবোধের রাজনীতি
জন্মলগ্ন থেকে ইসলামি মূল্যবোধের রাজনীতিকে অনেকটা এককভাবে ব্যবহার করত এবং এর সুবিধা পেত বিএনপি। এখন সে পরিস্থিতি নেই, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। ফলে ২০০১ সালে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর তা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায় বিএনপির জন্য। একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে বিএনপি যে ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলত, চারদলীয় জোট সরকারের সময় তা ‘ইসলামি মূল্যবোধে’ পরিণত হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহলে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণা কাটাতে বিএনপি কয়েক বছর ধরে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একধরনের দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ফলে ইসলামি দলগুলোর অনেকে বিএনপি–জোট থেকে সরে যায়। সর্বশেষ বিএনপি জোট ছাড়ে কওমি আলেমদের পুরোনো দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। একসময় উগ্রবাদ সমর্থক বলে প্রয়াত শায়খুল হাদিস আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর বিষয়ে প্রচার ছিল। আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট ২০১৬ সালে বিএনপি জোট ছেড়ে যায়। আর শায়খুল হাদিসের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোট ছাড়ে তারও অনেক আগে। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্ক এখন ততটা সাবলীল নয়।
এখন বিএনপি জোটে নিবন্ধিত ইসলামি দল বলতে আছে খেলাফতে মজলিস। এর বাইরে যে কয়টা ইসলামি দল জোটে আছে, সেগুলো মূলত বেরিয়ে যাওয়া দলগুলোর খণ্ডিত অংশ। এর মধ্যে মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিসও জোট ছাড়তে পারে বলে গুঞ্জন আছে। কারণ, দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতার মামলায় এখন কারাবন্দী। তাঁকে মুক্ত করতে দলের কেউ কেউ বিএনপির জোট ছাড়ার কথা ভাবছেন। কারণ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর দলটির নেতারা মুক্তি পান। জোট ছাড়ার পর সব দলই ‘অবহেলার’ অভিযোগ তুলে বিএনপিকে দোষারোপ করছে।
অন্যদিকে এ দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সখ্য বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকার কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে, আলেমদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে, এমনকি পবিত্র কাবা শরিফের ইমামকেও তারা দেশে এনেছে। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির চর্চার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতিকেও আওয়ামী লীগ ভালোভাবে ব্যবহার করছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ নেই। এখন যুদ্ধ অর্থনীতির, পারস্পরিক স্বার্থের। তালেবানের সঙ্গে আমেরিকা বসতে পারলে, হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় এসে অসাম্প্রদায়িক হতে পারলে বিএনপির ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে সমস্যা কী?’
অবশ্য বিএনপির নেতা ও দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একটি অংশের মধ্যে এর বিপরীত কথাও আছে। তা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএনপির ওপর ধর্মীয় শক্তিগুলোর বড় ধরনের প্রভাব তৈরি হয়েছে। যার প্রভাবে বিএনপি ‘ডানপন্থীর বামে, বামপন্থীর ডানে’ বলে যে দাবি করত, তা হারিয়ে যায়। ফলে বিএনপি কি মধ্যপন্থার রাজনীতি, নাকি পশ্চাৎপদ রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়, সে বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে।
প্রভাব ও বিস্তারে পিছিয়ে
বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলছেন, সমাজে নতুন চিন্তা সৃষ্টি করে এবং অন্যের ভাবনা-চিন্তাকে প্রভাবিত করে, জন্মলগ্নে বিএনপিতে এমন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ছিল। তা এখন কমে গেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি দরকার; যেমন শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, আমলা, সাংবাদিক—এই অংশের মধ্যে বিএনপির প্রভাব ও সমর্থন কমে এসেছে। তাঁদের পর্যালোচনা হচ্ছে, সমাজের একটি স্তরে বিএনপির ভালো জনসমর্থন আছে। কিন্তু তাদের হাতে ভোট দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই, তা–ও যদি ভোট দেওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ পায়। কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, সেটি নির্ধারণ করার জন্য সমাজের এই ক্ষুদ্র অংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; যা এখন অনেকটাই সরকারি দল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে।
অবশ্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আমলার সমর্থন দুই দলের প্রতিই আছে। তিনি কার্ল মাক্সকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘এঁরা হচ্ছেন রাষ্ট্রের অমৌলিক শ্রেণি। এঁদের বেশির ভাগ সুবিধা বুঝে কাজ করেন। কিছু কিছু আছে, যাঁরা চরিত্র পাল্টায় না। পার্থক্যটা হচ্ছে, কেউ সরকারের তাঁবেদারি করে, কেউ দেশপ্রেমের প্রশ্নে অনড় থাকে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমাজে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে, এই মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণিকে আকৃষ্ট করার মতো ইতিবাচক রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি বা কৌশল নিতে পারেননি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। একইভাবে দলটি প্রতিষ্ঠালগ্নে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে বাজার অর্থনীতির প্রবর্তন করেছিল, সেটিও এখন আওয়ামী লীগের হাতে। আওয়ামী লীগের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিপরীতে বিএনপি বিরাষ্ট্রীয়করণ, ব্যক্তিমালিকানা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় বাজার অর্থনীতি এমনভাবে গ্রহণ করেছে যে এর নেতিবাচক চর্চায় দুর্নীতি এখন অতীতের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর বিপরীতে বিএনপির আধুনিক অর্থনীতির ফর্মুলা কী হবে, সেটা নিয়ে দলটি এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেনি।
বিএনপির টিকে থাকা
প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরের মধ্যে বিএনপি এখন যে সবচেয়ে সংকটাপন্ন সময় পার করছে, তা নিয়ে দলটির নেতা–কর্মীদের মধ্যে দ্বিমত নেই। এর মধ্যে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে অনেক দিন কারাগারে ছিলেন। নির্বাহী আদেশে বাইরে থাকলেও পুরোপুরি মুক্ত নন। তার ওপর তিনি বেশ অসুস্থ। তাঁর অবর্তমানে লন্ডনপ্রবাসী বড় ছেলে তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল চালাচ্ছেন। কিন্তু দলের নীতি–কৌশল নির্ধারণে নেতৃত্বের মধ্যে যে ঐক্য–সংহতি দরকার, সে ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে অনেক।
গত ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে দলটি। এই সময়ে সারা দেশে অসংখ্য নেতা-কর্মী হামলা, মামলা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় তথ্য সংরক্ষণ সেলের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৫৯৩টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৭৪ হাজার ৯৮৯ জনকে। এই সময়ে ১ হাজার ৫২৬ জন খুন ও ৪২৩ জন গুমের শিকার হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুরুতর আহত হন ১১ হাজার ১২৬ জন।
২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পর পর তিনটি সাধারণ নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও একই পরিণতি হলে বিএনপির নেতৃত্ব এবং এর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই সংশয় দেখা দেবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপির পাশে দৃশ্যমান কোনো বহিঃশক্তি নেই। একতাবদ্ধ হয়ে যে কাজ করা, বিএনপির ভেতরে সেটাও নেই। তবু আমি বলব, এত জুলুম, নির্যাতনের মধ্যেও যখন বিএনপি বেঁচে আছে, তখন বিএনপি বেঁচে থাকবে।’
বিএনপির নেতারাও মনে করেন, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি টিকে আছে, এটাই বড় সাফল্য। মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এত কিছুর মধ্যেও বিএনপির বড় সাফল্য হচ্ছে, বিএনপি ভাঙেনি। ১৯৮১ সালের পর বিএনপি ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপিকে ভাঙার জন্য দুটি কমিটিও করে দিয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে।’
বিএনপির নেতারা মনে করেন, দলটি এখনো প্রাসঙ্গিক, যার প্রমাণ প্রতিদিনই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-নেতাদের বিএনপিকে নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। আগামী দিনে এই প্রাসঙ্গিকতা বিএনপি ধরে রাখতে পারবে কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন। কারণ, বিএনপি একটা বড় জনসমর্থন রয়েছে, কিন্তু সেটাকে ক্ষমতাসীনদের বিকল্প শক্তি হিসেবে হাজির করার জন্য যে পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও দূরদর্শী নেতৃত্বসহ প্রাসঙ্গিক অন্য শর্তগুলো পূরণ করা দরকার, সেখান থেকে বিএনপি এখনো অনেক দূরে।