দল বিলুপ্তি নিয়ে জামায়াতে দ্বন্দ্ব

>

*সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা হয়
*একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়
*দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত
*বিষয়টি দলের মজলিশে শুরায় অনুমোদন পায়নি
* ২০-দলীয় জোটে না থাকার সিদ্ধান্তে প্রায় সবাই একমত
*কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন নামে দল গঠন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তাব নতুন করে আলোচনায় এসেছে জামায়াতে ইসলামীতে। দলটির নেতৃত্বের একটা অংশ এ ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে। এই অংশ একাত্তরের ভুল স্বীকার করে বর্তমান নামে দলকে সচল রাখতে অথবা নতুন নামে দল গঠন করতে চায়। দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রায় ৯ বছর আগে অনেকটা একই রকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন পর কারাগার থেকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রস্তাব করেছিলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দায়িত্বশীলদের হাতে জামায়াতকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি একাধিক বিকল্পের মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতের নামও বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারসহ তখনকার জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাধার কারণে সেটা আর এগোয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলের তরুণ নেতৃত্বের একটি অংশ নতুন করে ওই প্রস্তাব ও আলোচনা সামনে এনেছে।

জামায়াতের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র জানায়, গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার জন্য সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা হয়। দলের তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে সভায় একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াত নামক দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে দলকে নিয়োজিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থা মজলিশে শুরায় অনুমোদন পায়নি। সেখানে ২০-দলীয় জোটে আর না থাকা ও কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রায় সবাই একমত হন।

দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা বলছেন, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের মুখে দলটির নেতা-কর্মীরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। শীর্ষ নেতাদের অনেকের ফাঁসি হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে। এ সময় অসংখ্য নেতা-কর্মী হতাহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজার হাজার নেতা-কর্মী। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত নেতা-কর্মীরা কয়েক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে প্রবীণেরা আপাতত গঠনতন্ত্রের একটি ধারা স্থগিত রেখে দলকে সামাজিক সংগঠন হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে চান। তাঁরা চলমান রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণের মুখে একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার মূল্যায়ন করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে সম্মত নন। তাঁরা মনে করেন, রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে এমন মূল্যায়ন করা সঠিক হবে না। প্রবীণদের মধ্যে এই প্রবণতা আগেও ছিল।

কামারুজ্জামান দলের সংস্কার প্রস্তাব করে কারাগার থেকে চিঠি লেখার পর জামায়াতের তখনকার আমির মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী ও দলের মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি শামসুন্নাহার নিজামী এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি ২০১১ সালের ১১ ও ২৫ মার্চ সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় দুই কিস্তিতে একটি নিবন্ধ লেখেন। ‘বিবেচনায় আনতে হবে সবকিছু’ শিরোনামে লেখা ওই নিবন্ধে শামসুন্নাহার নিজামী লেখেন, জামায়াত মনে করে, যেকোনো পরিস্থিতিতে বা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো কর্মকৌশল নয়, বরং শাশ্বত কর্মকৌশলই অবলম্বন করতে হবে। পরিস্থিতি যতই নাজুক হোক, চ্যালেঞ্জ যত কঠিনই হোক; শর্টকাট কোনো পথ নেই।

সম্প্রতি দল বিলুপ্ত করার প্রস্তাব আলোচনায় এলে মতিউর রহমান নিজামীর ছোট ছেলে নাদিমুর রহমান তালহা এটাকে ‘বেইমানি’ বলে মন্তব্য করেন। গত ১৭ জানুয়ারি তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে লেখেন, ‘...নিছক শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এবং শত্রুকে খুশি করার জন্য তার নিজের রক্ত দিয়ে গড়া ঘরটি ভেঙে দেওয়া কোনো বিবেকবান ব্যক্তির কাজ হতে পারে না।’

জানা গেছে, সত্তরের দশকের শেষভাগে থেকে যাঁরা ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের অনেকের বিবেচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার জন্য জামায়াতের ভুল স্বীকার করা উচিত। এই অংশটি মনে করে, একাত্তরে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকার পরও তাঁদের ভুলের দায় আর বহন না করাই উত্তম। তাঁরা মনে করেন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের ব্যাপক বিজয়ের পর দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বিশিষ্ট আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক একাত্তরের মূল্যায়ন ও ভুল স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার যে প্রস্তাব তুলেছিলেন, তা করা হলে আজ জামায়াতকে এত বড় রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মুখে পড়তে হতো না। তখন জামায়াতের অন্য দুই প্রভাবশালী নেতা কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলীও এ মতের অনুসারী ছিলেন।

দলের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র জানায়, মূলত দলে এই চিন্তার অনুসারী নেতা ও সমর্থকদের বড় একটি অংশ একাত্তরের মূল্যায়ন সম্পন্ন করে জামায়াতে ইসলামীকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার পক্ষে। তাঁরা মনে করেন, এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জামায়াতকে বিলুপ্ত করার পর নতুন একটি গণতন্ত্র অভিমুখী দল গঠন করে রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব।

তরুণ নেতাদের একজন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান (মঞ্জু)। তাঁর সাম্প্রতিক ফেসবুক বার্তা নিয়ে দলের ভেতর নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের প্রায়ই নিজেদের অক্ষমতা, অনৈক্য, নেতৃত্বের সীমাহীন দুর্বলতা নিয়ে আফসোস করতে দেখা যায়। ইসলামিস্টরা এখন দ্বিধা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে অকপটে বলছেন, তাঁদের বয়ান বদলাতে হবে। ইসলামি রাষ্ট্র, খেলাফত বা শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র নয়, আগে দরকার সুশাসন, সাম্য, মানবাধিকার।...অতএব, নতুন করে আলো জ্বালাবার এই তো সময়।’

দল বিলুপ্ত করে নতুন দল গঠন করার বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকে নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে। নতুন দল করার বিষয়টিও আলোচনার টেবিলে আছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি একাত্তরের ভুল স্বীকারের বিষয়ে বলেন, ‘আমরা তো দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান—এগুলো মেনেই কাজ করছি এবং জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তারপরও এ বিষয়ে (মুক্তিযুদ্ধ) আর কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা আছে এবং হচ্ছে।’

আরও পড়ুন:
বিএনপির সঙ্গে আর থাকছে না জামায়াত