ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদচ্যুত করাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা দেখছেন ‘কড়া বার্তা’ হিসেবে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ নিজেদের আইন–আদালতের ঊর্ধ্বে মনে করছেন উল্লেখ করে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের আশা, দলীয় প্রধানের (শেখ হাসিনা) কঠোর অবস্থান ওই সব নেতার ‘কাজে’ লাগাম টানবে ।
তবে দলটির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা এও মনে করেন, দলটির সব পর্যায়ের নেতারা আদৌ এই বার্তা মেনে কাজ করবেন কি না, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যেই সংশয় আছে। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধ যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা ‘নজিরবিহীন’। এটা অতীতে কখনো হয়নি। অপরাধ করলে কেউই ছাড় পাবে না।
গত শনিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ও এর আগে দলের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন তিনজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তাঁদের পদচ্যুত করেছেন। তবে আলোচনা শুধু ছাত্রলীগের দুই নেতার ‘অপকর্মের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের আচরণ, কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কাউকে কাউকে ইঙ্গিত করেও কথা বলেছেন। ওই নেতারা বলেন, মূল দল ও সহযোগী সংগঠনের বেশ কিছু নেতার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন বলেই তাঁদের মনে হয়েছে। এই নেতাদের নিয়ে বাইরে নানা সমালোচনা আছে। বিশেষ করে চাঁদাবাজি, কমিশন নেওয়ার মতো কাজের সঙ্গে এঁরা ‘খারাপ’ভাবে জড়িয়ে গেছেন।
এই তিন নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সব খবরই তিনি রাখেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেলেই তিনি ব্যবস্থা নেবেন। তাঁরা বলছেন, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে, যেটা অতীতে কখনো হয়নি। আজমেরী ওসমানকে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ত্বকী হত্যার প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। এ ঘটনায় তাঁদের মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কাউকে ছাড় দেবেন না।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ভঙ্গের নানা ঘটনা এখন সামনে আসছে। ব্যক্তি (ইনডিভিজ্যুয়াল) অপরাধ দলের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বৈঠকগুলোতে সরাসরি কারও নাম উল্লেখ না করে বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন ও মূল দলের কারও কারও ব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ওই সূত্রের দাবি, এসব নেতার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এসেছে।
শনি ও রোববার আওয়ামী লীগের চারজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে দলের নেতাদের ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃত্বের কঠোর অবস্থান নিয়ে কথা হয়েছে। তবে এই নেতারা কেউই নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চাননি।
আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত সৎ ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। যাঁদের বাইরে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি আছে, তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কথাবার্তায় তাঁর এমনটাই মনে হয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু শীর্ষ নেতার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ, তা বোঝাই যায়। রেজওয়ানুল-রাব্বানীর বিষয়ে ত্বরিত ও সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়াটা এমনই একটা ইঙ্গিত।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম মনে করেন, এ ঘটনা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর জন্য একটা সতর্কবার্তা। তিনি এ থেকে সব পর্যায়ের নেতা–কর্মীকে সতর্ক হওয়ার আহ্বানও জানান। গণমাধ্যমকে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, রেজওয়ানুল-রাব্বানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউই অপরাধ করে ছাড় পাবেন না, এটাই দলীয় প্রধান বলে দিয়েছেন। তাই সবাইকে সতর্ক হতে হবে। কোনো অপকর্মে জড়ানো দলের নেতা-কর্মীদের উচিত হবে না।
দলটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই দলের নেতা–কর্মীদের অপকর্মে জড়িয়ে পড়াকে অপছন্দ করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো তাঁর কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকে না। কিন্তু কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে কী ধরনের ব্যবস্থা তিনি নেবেন, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই নেতা বলেন, দল নেতা–কর্মীদের ব্যাপারে কঠোর হচ্ছে। দলের বিরুদ্ধে বা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের ইতিমধ্যে শোকজ করা হচ্ছে। ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে আছেন, এমন নেতাদের কর্মকাণ্ডও খুঁজে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, জনগণ কোনো স্তরের আওয়ামী লীগের নেতার বিরুদ্ধে গেলে বা তার কাজে বিরক্ত-ক্ষুব্ধ হলে সেটা তো দলের বিরুদ্ধেই যায়।
রোববার দুপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন, রেজওয়ানুল-রাব্বানী দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের সঙ্গে যাঁরাই জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।